ভারতের নষ্টামি থেকে বাঁচতে জিয়াউর রহমানের যে সিক্রেট প্ল্যান
(ব্রিটিশ ক্যানেল নেটওয়ার্ক এবং জিয়াউর রহমানের খাল কাটা স্বনির্ভর বিপ্লব নিয়ে আমি ৭/৮ বছর আগে একটি ডিটেইলস পোস্ট দিয়েছিলাম।
কিন্তু তখন জিয়াউর রহমানের নামে পজিটিভ কিছু লেখা মানেই আপনি তাদের ওয়াচ লিস্টে ঢুকে গেলেন।
তাই তখন বহু পোস্ট লিখে “অনলি মি” বা ডিলিট করে দিতে হয়েছে।
নায়েল রহমানের কিছু ফ্রেন্ডের রিকোয়েস্ট সেই পোস্ট খুঁজে না পেয়ে এবার ছোট আকারে আবার লিখলাম । )
রোমানরা যখন ইংল্যান্ডে রাজ্যত্ব করতো তখন তারা নির্দিষ্টি কিছু খাল খনন করে আদ (AD50) কিছু জায়গায় চাষাবাদের ব্যবস্থা করে।
কিন্তু পরবর্তীতে সেটা তেমন আর বাড়ানো হয়নি কারণ সারা ব্রিটেন জুড়েই রয়েছে ছোট বড় নানা পাহাড় পর্বত , চাষাবাদের জন্য সমতল ভূমি তেমন ছিল না। উঁচুনিচু হিলি এবং পাহাড়িয়া জায়গায় খাল খনন সোজা ব্যাপার নয়।
তবে ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে যখন ব্রিটেনে কয়লার খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে বিভিন্ন মিলগুলোতে কয়লার প্রয়োজন পরে তখন ব্রিটেনের ইঞ্জিনিয়াররা ১৭৫৯ সালে আবার নতুন করে খাল খননের কাজে হাত দেয়।
৩৯ মাইল লম্বা ব্রিজওয়াটার ক্যানেল ১৭৭৬ সালে শেষ করে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার জেমস ব্রিন্ডলী।
পরবর্তীতে ব্রিটেনে সেই খাল খনন কর্মসূচি বাড়তে বাড়তে আজ টোটাল ৪৭০০ মাইল খাল হয়েছে ।
ব্রিটেনের ইন্ডাট্রিয়াল রেভুলেশনের পিছনে যে স্টিম ইঞ্জিনের সবচেয়ে বেশি অবদান , সেই স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত ব্রিটেনের হাজার হাজার মাইল ক্যানেল বা খাল ছিল ব্রিটেনের ইকোনমির মেরুদন্ড ।
খালগুলো এমনভাবে তৈরী করা হতো যাতে খালের পাশে ঘোড়া চলাচলের রাস্তা থাকে।
এতে নৌকা বোঝাই টনকে টন মাল ঘোড়া টেনে নিয়ে যেত পারতো অনায়েসে।
ব্রিটেনের খনিগুলো থেকে কয়লা , স্লেট , লেড এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ এই খাল দিয়েই দেশের নানা জায়গায় নেয়া হতো এবং সমুদ্র বন্দরে নিয়ে সারা দুনিয়ায় বিক্রি করতো।
এভাবেই হাজার হাজার মাইল খাল ব্রিটেনের ইকোনোমিকে চাঙ্গা করে রেখেছিল ১৮শতকে।
জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আসেন তখন বাংলাদেশের ইকোনমির অবস্থা চরম খারাপ।
উনি ক্ষমতায় আসার মাত্র তিন বছর আগে ৭৪ সালে বাংলাদেশ স্মরণ কালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ কেবল পার করে আসে, এবং তার রেশ তখনও চলছিল।
ফলে সারা দেশ জুড়েই বেকার মানুষ বসে আছে কোন কাজ নেই , কিন্তু তাদেরকে তো খেতে হবে।
তা ছাড়া যোগাযোগ ছিল খুব খারাপ , যুদ্ধ বিদ্ধস্ত নতুন দেশে তখনও আন্তজেলা রাস্তাগুলোও সম্পূর্ণরূপে চালু হয়নি।
ফলে দেশের কোথাও কোথাও উদ্বৃত্ত ফলন হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে খরা বা মঙ্গা প্রবন এলাকাতে খাদ্য পাঠানো যাচ্ছিলো না।
ফলে এক অঞ্চলে চাষিরা অতিরিক্ত ফলনে শস্যের দাম পাচ্ছিলো না , আবার অন্য অঞ্চলে খাদ্যের অভাবে মঙ্গা চলছিলো।
এই সময় ব্রিটিশ ডিসিপ্লিনে গড়া জেনারেল জিয়া একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন ।
সে সময় পৃথিবীর অন্যতম গরিব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল একেবারেই নিচের দিকে।
হয়তো আফ্রিকার দুএকটি নাম না জানা দেশ আমাদের নিচে থাকলেও থাকতে পারে সে সময় ।
এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ , খরা , অনাবৃষ্টি , অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া।
আর সেই সাথে ভারতের বৈরিতা ছিল এখনকার মতোই ।
কারণ, যে কারণে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেতে সাহায্য করেছিল , জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হয়ে সেই আশার গুড়েতে বালি ঢেলে দেয়।
ফলে ভারত এখন যেমন বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া কুত্তা পাগল হয়ে সকল বাঁধ এক রাতে খুলে দিয়েছে , ঠিক তখনও খরার সময় পানি আটকে রাখতো , আর বর্ষায় সমস্ত বাঁধের গেট খুলে দিয়ে কৃষকের ফসল এক রাতে নষ্ট করে দিতো।
দুর্ভিক্ষ থেকে উঠে আসা বাংলাদেশের তখন প্রধান সমস্যা ছিল খাদ্য।
জিয়াউর রহমান জানতেন আগে দেশের মানুষকে দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে , এরপর বাকি সব।
অত্যন্ত বিচক্ষণ প্রেসিডেন্ট জিয়া তখন ভাবলেন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং ভারতের নষ্টামী থেকে বাঁচার একটি উপায় হলো , বর্ষায় যখন অতিরিক্ত পানি আসবে তখন সেটাকে সংরক্ষণ করে কৃষি কাজে ব্যবহার করতে হবে।
মনে রাখতে হবে সেই যুগে সারা দেশে কোথাও আজকের মতো ডিপ-টিউবয়েল অথবা স্যালো মেশিন ছিল না ইরিগেশনের জন্য।
ফলে খরা একটি নিত্য দুর্যোগ ছিল বাংলাদেশের জন্য।
আমার ধারণা প্রেসিডেন্ট জিয়া কোন না কোনভাবে ব্রিটেনের ক্যানেল নেটওয়ার্কের কথা জানতেন।
আর যদি না জেনেও থাকেন তবে আমি মনে করি একজন প্রকৃত রাষ্ট্র নায়কের মতোই তিনি দেশের এই চরম সমস্যা মোকাবেলার জন্য খাল খনন কর্মসূচি হাতে নেন।
খাল খননের মাধ্যমে শুধু সেচের ব্যবস্থায় হলো না, সেই সাথে সংযোগ খালের মাধ্যমে কৃষক তার ফসল হাটে বাজারে পাঠাতে শুরু করলো সহজেই ।
আর নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রতিটি হাটবাজারই নদীর তীরে অবস্থিত , ফলে এক জেলার ফসল অন্য জেলায় পাঠানো অনেক সহজ হয়ে যায়।
কিন্তু পরবর্তীতে এরশাদ এসে প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই যুগান্তকারী খাল খনন কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়।
আজ যদি সেই খাল খনন কর্মসূচি সারা দেশে সম্পন্ন থাকতো এবং চালু থাকতো, তাহলে আজকে আমরা যেমন বিনা নোটিশে পানির তলায় ডুবে গেলাম সেটা অন্তত হতো না।
খালগুলো দিয়ে পানি অনেকটাই দ্রুত মেনে যেতে পারতো এবং মানুষ সময় পেতো নিরাপদে আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য , ভয়াবহতা এতো চরম হতোনা।
ইরিগেশন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও আর একটি বড় দিক ছিল খাল খনন কর্মসূচির।
পশ্চিমা বিশ্বে যারা কাজ করেছেন , অথবা কর্পোরেট লেভেলে যারা কাজ করেছেন তারা জানেন প্রতিটি কর্পোরেট লেভেলে কাজ করার আগে একদিন বা দুই দিনের জন্য “টিম-বিল্ডিং”-এর জন্য ট্রেনিং-এ পাঠানো হয়।
এই টিম-বিল্ডিং যে কত গুরত্বপূর্ন তা যারা কর্পোরেট লেভেলে কাজ করেছেন তারাই জানেন।
এছাড়া আমরা যে সেনাবাহিনীর জন্য এতো গর্ব করি এর একটি কারণ হলো , তাদেরকে তৈরী করা হয় একটি টিম হিসেবে এবং কাজও করে একটি কমপ্লিট টিম হিসেবে ।
ফলে তাদেরকে কোন কাজ দেয়া হলে সেটা তারা শেষ করেই ঘরে ফিরে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর দেখলেন পুরোদেশ ভিন্ন ভিন্ন মতে নানা ভাগে বিভক্ত।
এতো বিভক্ত একটি জাতি নিয়ে দেশ গঠন করা যায় না।
তাই তিনি প্রথমে এই দেশ গঠনের জন্য একটি “টিম- বিল্ডিং”-এর কাজে হাত দিলেন।
আর উনার খাল খনন কর্মসূচি ছিল সেই টিম বিল্ডিং-এর প্রথম ধাপ।
সারা দেশের ছেলে ,বুড়ো জুয়ান, ছাত্র শিক্ষক, মাদ্রাসার ছাত্র , মসজিদের ইমাম, গ্রামের বেকার যুবক , টাউট , আমলা , কামলা , রাজকার, মুক্তিযুদ্ধা সবাইকে তিনি এই কাজে সম্পৃক্ত করে সারা দেশে খাল খনন কর্মসূচি চালু করে দিলেন।
আর এরজন্য তিনি প্রতিটি জেলার গ্রামেগঞ্জে গেঞ্জি পরে, সারা শরীরে কাঁদা মেখে, মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে গেলেন দেশ গঠনে।
একজন রাষ্ট্র প্রধানকে গ্রামের মানুষ তাদের বাড়ির আঙিনায় পেয়ে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে খাল খননে অংশ গ্রহণ করে দেশ গঠনে নেমে গেলো।
আমি মনে করি উনার জনপ্রিয়তার এই “টিম বিল্ডিং “-ই ছিল মূল চাবিকাঠি।
আসলে খাল খনন কর্মসূচিতে মানুষকে কাজের মধ্যে ঢুকিয়ে টিম বিল্ডিং-এর মাধ্যমে একে ওপরের সাথে ভাতৃত্ববোধ তৈরী করা ছিল জিয়ার রহমানের মনের সুপ্ত, সিক্রেট একটি প্ল্যান, যা আপনি কখনো কোন পত্রিকার পাতায় বা বইতে দেখতে পাননি ।
তাহলে আমি কিভাবে এব্যাপারে জানলাম ?!
আজ থেকে ৩৩ বছর আগে আমি যখন ইউরোপে পারি দেই তখন আমি এক নিতান্তই সাধারণ দেশি ভাইয়ের সাথে পরিচিত হই।
উনার জীবন কাহিনী নিয়ে আসলে একটি বই লেখা যাবে।
উনি কিশোরগঞ্জের একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছেন। সেই সময়ই তিনি ১৭ বছর যাবৎ ইউরোপে ছিলেন।
উনি সাতদিন বরফের মধ্যে পায়ে হেটে ইউরোপে পৌঁছান। লেখাপড়া তেমন জানেন না, কিছুদিন মাদ্রাসায় পড়েছিলেন মাত্র।
উনার সাথে নানা কথা হয়েছিল, উনার জীবন কাহিনী খুব কষ্টের এবং দুঃখে ভরা ছিল।
একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশে আপনার কোন আনন্দঘন মুহূর্ত ছিল হাবীব ভাই ?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন , ” ভাই আমরা গ্রামের গরিব মানুষ , দেশে কোনদিন টিভি তো দূরে থাক , ঘরে ইলেকট্রিসিটি পর্যন্ত ছিল না।
গ্রামের গরিব মানুষের জীবনে আনন্দ ফুর্তি বলতে কিছু থাকে না।
তবে জীবনে কয়েকটা দিন চরম আনন্দের মধ্যে কাটিয়েছিলাম।
জিয়াউর রহমান সাহেব যখন খাল কাঁটা চালু করলেন , তখন আমরা মাদ্রাসার ছাত্ররা পাঁচদিন খাল কাটতে গিয়েছিলাম।
সারাদিন খাল কাটার পর খিচুড়ি খেতাম , সেই খিচুড়িতে আমরা অমৃতের স্বাদ পেতাম !
আর সেইদিন গুলি যে কি আনন্দে কেঁটেছে, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমার জীবনে আনন্দ বলতে সেইদিনগুলিই আমার স্মৃতি হয়ে আছে ” ।
হাবিব ভাইয়ের সেই কাহিনী শুনার পর তখন আমার মনে হয়েছিল জিয়ার রহমানের চরম জনপ্রিয়তার সিক্রেটটি আমি আজ পেয়ে গেলাম !
হাবীব ভাইয়ের মতো কোটি কোটি মানুষের মনে জিয়াউর রহমান একটু হলেও আশার আলো দেখিয়েছিলেন , একটু হলেও জীবনে আনন্দের ছোঁয়া দিয়েছিলেন।
সেজন্য মানুষ তাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে, স্মরণ করে, আজও তিনি সমান জনপ্রিয় ।
– শাফি হক