বাংলাদেশ

বাবা চা বিক্রেতা, ছেলে ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েই কোটিপতি

শুকুমার চন্দ্র দাস (৬০)। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার একজন পরিচিত চা বিক্রেতা। নিজের সহায় সম্বল বলতে কিছুই ছিল না। চা বিক্রির আয় দিয়ে ভাড়া বাসায় থেকে দুই ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছেন।

ছোট ছেলে সনজিত চন্দ্র দাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেও গৌরীপুর পৌর সদরে সোনালী ব্যাংকের সামনে চা বিক্রি করতেন শুকুমার।

ছেলে সনজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি হলে নিজেকে গুটিয়ে নেন শুকুমার। আর কখনো চা বিক্রি করতে হয়নি তাকে। এখানেই শেষ নয়, সনজিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অ্যাসাইন্টমেন্ট অফিসার হলে তার পা আর মাটিতে পড়ে না।

এ যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান শুকুমার। অল্প দিনেই ভাড়া বাসা ছেড়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে সনজিতের কেনা বাড়িতে ওঠেন।

ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মাঝিপাড়া (সরকারপাড়া) এলাকায়। ২০২৩ সালের ২১ মার্চ ৫৩ হাজার ৬০ টাকা বেতনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাসাইন্টমেন্ট অফিসার হিসাবে চুক্তিভিক্তি নিয়োগ পান তিনি।

জানা যায়, সনজিত ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ২০১৬ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি পুরো ময়মনসিংহকে কব্জায় নেন। ওই সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় নির্বাচন ও এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন বা কমিটির সকল কিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বাণিজ্যও হতো তার নেতৃত্বে। এমনকি অনেক এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারাও সনজিতের কথা মতো চলতেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার হওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েন সনজিত। নিজের পদ-পদবি ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করে কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

গতকাল শুক্রবার সকালে সনজিতের পরিবারের খোঁজ নিতে তার সরকারপাড়া বাসায় গেলে তালা ঝুলতে দেখা যায়। প্রতিবেশীরা জানান, সনজিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকরি পাওয়ার পরপরই পুরো পরিবার ঢাকায় থাকতেন। সেখানে নিজেদের ফ্ল্যাট বাসায় থাকতেন। বছর খানেক আগে নুরুল হক নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৬ শতক জমিসহ বাড়িটি প্রায় ৫০ লাখ টাকায় কিনেছিলেন। কিছু দিনের মধ্যে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণে পরিকল্পনাও ছিল তার। এর মধ্যে গত ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী দেশে ছেড়ে পালিয়ে গেলে সনজিত ও তার পরিবারও ভারতে চলে যান। নামে বেনামে উপজেলার অনেক জায়গায় জমি কিনেছেন বলেও জানান প্রতিবেশীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সনজিতের বড় ভাই ঢাকা কলেজের শিক্ষক ছিলেন। সেখান থেকে সনজিত প্রভাব বিস্তার করে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রায় দুই লাখ টাকা বেতনের চাকরি ভাগিয়ে দেন।

এলাকার লোকজন জানান, সনজিতের বাবা ছিলেন অত্যন্ত অসহায় হতদরিদ্র মানুষ। নিজের সহায় সম্বল বলতে কিছুই ছিল না। পরিবার সন্তানদের পড়াশোনা করাতে চায়ের দোকান দিয়ে হাল ধরেন। পৌর সদরের সোনালী ব্যাংকের সামনে চা বিক্রি করে তিনি অনেক সুনাম অর্জন করেছেন।

মোস্তাকিন নামে একজন চা বিক্রেতা জানান, শুকুমার এক বেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতেন। অনেক কষ্ট করে ছেলেদের পড়িয়েছেন। এ অবস্থায় ছোট ছেলে সনজিত চন্দ্র দাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আর পেছনে ফিতে তাকাতে হয়নি। ছাত্রলীগের নেতা হয়ে গেলে তার ভাগ্য ঘুরে যায়। পরবর্তীতে ছেলে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অ্যাসাইন্টমেন্ট অফিসার হলে পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। বৃদ্ধ মা-বাবা ও পরিবারের অন্যদের ঢাকায় নিয়ে যান। সেখানে তারা আয়েশি জীবনযাপন করেন।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন চলাকালে গৌরীপুরে সনজিতের অনুসারীরা কোটা অন্দোলকারীদের ওপর বেশ কয়েকবার হামলা চালায়। এতে অনেককেই আহত হন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এনামুল হাসান অনয় আহত হন। এনামুলের বাড়ি গৌরীপুরে। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন। তার বোন অর্পিতা কবির এনি গৌরীপুর উপজেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি।

অনয় জানান, কোটাবিরোধী তীব্র আন্দোলন চলাকালে গত ২১ জুলাই পৌর সদরে গণপাঠাগারের সামনে সনজিতের ক্যাডার পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক উত্তম সরকারে নেতৃত্বে তার ও বোনের ওপর হামলা চালিয়ে মারধর করে। এ সময় অর্পিতাকে মাটিতে ফেলে পেটানো হয়। ঘটনার পর থানায় গিয়ে বিচার চাইলে ওসিকে ফোন করে মামলা নিতে নিষেধ করেন সনজিত।

অনয় আরো জানান, সনজিত ছাত্রলীগের নেতা থাকাকালীন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঢাকায় রয়েছে একাধিক বাসবাড়ি ও ফ্ল্যাট। রয়েছে অনেক টাকা। বিশেষ করে যে গৌরীপুরে তার বাবার কিছুই ছিল না, সেখানে কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। দুদক অনুসন্ধান করলে অনেক কিছুই বের হয়ে আসবে বলে তিনি মনে করেন।

সোর্স: দৈনিক দিগন্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button