বাংলাদেশ

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত খালিদের শরীরে ৭০ গুলির ফুটো

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত খালিদের শরীরে ৭০ গুলির ফুটো

শিশু বয়স থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল খালিদ হাসান সাইফুল্লাহর। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার শখ ও ইচ্ছা পূরণের চেষ্টায় কমতি ছিল না পরিবারের। ক্রিকেটে তার প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে পাড়া-মহল্লায়। আন্তঃস্কুল ক্রিকেট খেলায় চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল। ভালো ব্যাটিং করত। ইচ্ছা ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। তবে পুলিশের ছোঁড়া বুলেটে সে স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। কথাগুলো সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসানের।

সম্প্রতি রাজধানীর লালবাগের আমলিগোলায় এসব কথা জানান তিনি। কামরুল হাসান বলেন, ‘প্রচন্ড মিশুক ছেলে ছিল খালিদ। সে আমাদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল।’ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ (১৭) রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজে একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। খবর: বাসস।

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই বিকেলে আজিমপুর সরকারি আবাসিক এলাকার ৭ নম্বর ভবনের সামনে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ সরাসরি গুলি চালালে সাইফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সাইফুল্লাহ ২০০৮ সালের ২৯ মে রাজধানীর লালবাগের আমলিগোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কামরুল হাসান (৪৮) মাদ্রাসার শিক্ষক। পাশাপাশি তিনি হোমিও চিকিৎসকও।

বড় ছেলে হারানোর শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাবার মুখে তেমন কোন কথা নেই। প্রায় সাড়ে ৩ মাস চলে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারেননি তিনি। এছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই অবস্থা। কামরুল হাসান জানান,খালিদ প্রথম দিন থেকেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সেদিন আজিমপুর ছাপড়া মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে লালবাগের আমলিগোলার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ।

বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করে সেই সময় পুলিশও আজিমপুর কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে গুলি চালায়। অথচ এলাকাটি সংরক্ষিত। খালিদ গুলিবিদ্ধ হন। শটগানের অন্তত ৭০টি ছররা গুলির চিহ্ন ছিল খালিদের শরীরে।

কামরুল হাসান বলেন, ‘সাইফুল্লাহ মাকে আসরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে যায়। কিন্তু রাত ১১টায় চেম্বার শেষ করে বাসায় আসার পর ওর মা বলে, নামাজ শেষ করে এখনও বাসায় ফেরে নি সাইফুল্লাহ। আমি ওর মোবাইলে ফোন করি। অপরিচিত একজন ফোন ধরে আমাকে আমলিগোলা মক্কা হোটেলের সামনে যেতে বলেন। সেখানে গেলে ছেলের মোবাইল হাতে দেয় আমাকে। আমার ছেলের নামও ওরা জানত না। ওরা আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমরা মর্গে যাই।’

মর্গে অনেকগুলো একই বয়সী ছেলের লাশ দেখতে পান তিনি। সেখানেই নিজের ছেলের দেহ শনাক্ত করেন কামরুল হাসান। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখি অনেকগুলো লাশ একই বয়সের। সবাই ১৬ থেকে ১৮ বছরের। আমার ধারণা প্রায় ১৮-১৯টি লাশ ছিল। একপাশে আমার ছেলের লাশটাকে খুঁজে পেলাম। গায়ে খয়েরি পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা ও টুপি ছিল। কেউ খুলে নেয়নি।’

কামরুল হাসান বলেন, কতটা নির্মম, নির্দয়, পাষাণের মতো খালিদ সাইফুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে ৭০টি গুলির চিহ্ন ছিল। প্রথমে স্থানীয় সংসদ সদস্য সোলায়মান সেলিমের নির্দেশে তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আমার সন্তানের মাথায় গুলি করে। তারপর স্থানীয় কাউন্সিলর মানিকের নির্দেশে ৬/৭ জন পুলিশ দৌঁড়ে এসে ২ থেকে ৩ ফুট দুরত্ব থেকে খালিদের বুকে ও পেটে ৭০ টি গুলি করে। ছাত্ররা যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল তখন ইরফান সেলিম ও কয়েকজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাধা দেয়। এক পর্যায়ে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

খালিদের বাবা বলেন, ‘গত ১৮ জুলাই খালিদ নিহত হওয়ার সংবাদ শোনার পর থেকে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সব আত্মীয় চলে যাওয়ার পর আমরা এখন কতটা অসহায় বোধ করছি, তা বোঝানোর মতো নয়। মনে হচ্ছে, আমাদের ছেলের সঙ্গে আমাদের শরীরের শক্তিও চলে গেছে। প্রচন্ড দুর্বল অবস্থায় আছি আমরা এখন।’

সন্তান হারানোর বেদনার পাশাপাশি ওই সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে খালিদের বাবা আরও বলেন, কান্না করব, বুক ফেটে আসছিল। তারও কোনো উপায় ছিল না। ছেলের মরদেহ পাওয়া নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম আমরা। ১৮ তারিখ রাত থেকে বাসা, থানা, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ ঘোরাঘুরি করে আমার ছেলের মরদেহ হাতে পাই ২১ জুলাই। পরে ২২ তারিখ ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার সোড়ইবাড়ি কবরস্থানে তাকে দাফন করি।

তিনি বলেন, মর্গে যখন প্রথম তাকে আমি দেখি কীভাবে বোঝাব আমি সেটা, কী হয়েছিল ভেতরে আমার। ৭০টা সিসার ফুটো তার শরীরে। এতটুকু ছোট ছেলে। খালিদের মা রাতে যখন আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল ‘আমার ছেলেকে নিয়া আসছেন তো?’ এর উত্তর আমি কী দিতে পারতাম? ওর মা, বোন কান্নাকাটি করে করে প্রায় মূর্ছা যাচ্ছিল।আমি নিজের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছিলাম না কোনোভাবেই। ছেলেটা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। আমার ছেলে শহিদ হয়েছে।’

কামরুল হাসান বলেন, প্রত্যেকটা পরিবারের বড় ছেলে তাদের জীবনের স্বপ্ন ও স্মৃতিকে ধারণ করে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হয় তাকে ঘিরে। অথচ স্বৈরাচারের আশ্রিত সন্ত্রাসীর গুলিতে আমাদের সে পরিকল্পনা ও স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল।’

নির্মম এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলার মাটিতেই হতে হবে উল্লেখ করে খালিদের বাবা বলেন, কোনও সন্ত্রাসী যাতে আর বাংলার মাটিতে তৈরি না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বলতে চাই, বাংলার মসনদে আর কোনো স্বৈরাচারকে দেখতে চাই না। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের জাতীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। প্রত্যেক শহীদের পরিবার ১ কোটি করে টাকা করে পাক এবং তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হোক।

খালিদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় তার বাবা কামরুল হাসান ১৯ আগস্ট লালবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সংসদ সদস্য হাজি সেলিমসহ ৫২ জনকে আসামি করেছেন তিনি।

সূত্র: dailycomillanews

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button