বাংলাদেশ

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে আদিম গ্যালাক্সির সন্ধান!

সম্প্রতি জেমস ওয়েব নভোদুরবিন শিশু মিল্কিওয়ের মতো ভরের আদিম একটি গ্যালাক্সি শনাক্ত করেছে। এ গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশি গবেষক লামীয়া মওলা। প্রথমবারের মতো নাসার জেমস ওয়েব নভোদুরবিন শিশু মিল্কিওয়ের মতো ভরের একটি গ্যালাক্সি শনাক্ত করেছে। গ্যালাক্সিটির জন্ম বিগ ব্যাংয়ের ৬০০ মিলিয়ন বা ৬০ কোটি বছর পর।

১০টি উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ বা স্টার ক্লাস্টারের সমন্বয়ে গঠিত এ গ্যালাক্সির নাম দেওয়া হয়েছে ফায়ারফ্লাই স্পার্কল। ফায়ারফ্লাই মানে জোনাকি, গ্যালাক্সিটি দেখতে যেন ঠিক তাই—একগুচ্ছ জোনাকির ঝাঁক, ঝলমল করছে রাতের আঁধারে। জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিস্ময়কর এ জোনাকির ঝাঁক শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশি গবেষক লামীয়া মওলা ও নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির নাসা হাবল ফেলো কার্তিক আইয়ারের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী।

এ গবেষক দলে আরও রয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান, যিনি এ গবেষণাপত্রের সহ-লেখক। তাঁদের গবেষণাপত্রটি গত ১২ ডিসেম্বর বিশ্বখ্যাত নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

ইতিমধ্যেই জেমস ওয়েবের ঝুলিতে রয়েছে বিস্ময়কর সব গ্যালাক্সি আবিষ্কারের কৃতিত্ব। তাহলে এ গ্যালাক্সিটি নিয়ে আলাদা করে আলোচনার কারণ কী? কারণ, আগের কোনো গ্যালাক্সি এত কম ভারী ছিল না। কেমন ছিল মিল্কিওয়ের ছোটবেলা? জানা যাবে এ গ্যালাক্সি বিশ্লেষণ করে। পাশাপাশি গবেষকেরা এই গ্যালাক্সির নক্ষত্রপুঞ্জগুলোকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন। এ থেকে এ ধরনের গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রের গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রে উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিক।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ওয়েলেসলি কলেজের সহকারী অধ্যাপক লামীয়া মওলা। ফায়ারফ্লাই স্পার্কল গ্যালাক্সি শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি, ‘মহাবিশ্বের এত পুরোনো একটি গ্যালাক্সির প্রতিটি উপাদান এত সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে, এমনকি এর ভর আমাদের গ্যালাক্সির শুরুর দিকের ভরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে, এতটা আমি ভাবিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এত ছোট একটা গ্যালাক্সির ভেতরে এত কিছু ঘটছে, বিষয়টা বিস্ময়কর। তারার গঠন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ও রয়েছে এর মধ্যে।’

এই গ্যালাক্সির ১০টি নক্ষত্রপুঞ্জ ছড়িয়ে আছে প্রায় ১ হাজার আলোকবর্ষজুড়ে (১ আলোকবর্ষ মানে আলো এক বছরে যতটা পথ ভ্রমণ করে, দূরত্বটা প্রায় ৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার)। এর মধ্যে গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলে রয়েছে ৮টি নক্ষত্রপুঞ্জ, বাকি দুটি আছে দুপাশে বিস্তৃত বাহুতে।

লামীয়া মওলা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মহাবিশ্বের ইতিহাসে মিল্কিওয়ে খুব দ্রুতই গঠিত হতে শুরু করে, প্রায় একই সময় গঠিত হতে শুরু করে ফায়ারফ্লাই স্পার্কল। শিশু মিল্কিওয়ের মতো কোনো গ্যালাক্সির ভর আমরা যতটা আশা করি, এর ভরও সেরকমই পাওয়া গেছে। মিল্কিওয়ের বর্তমান ভরের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার ভাগ কম।’

এমন একটি গ্যালাক্সির স্পষ্ট ও সবিস্তার ছবি কেমন করে ধরল জেমস ওয়েব? মূলত দুটি বিষয় কাজ করেছে এর পেছনে। এক, গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং। বাংলায় বলা হয় মহাকর্ষীয় লেন্সিং। আসলে, ভারী বস্তুর ভর এর চারপাশের স্থান-কাল বাঁকিয়ে ফেলে। ফলে বহু দূরের কোনো বস্তুর আলো কাছাকাছি ভারী ও বিশাল গ্যালাক্সি ক্লাস্টার আরও উজ্জ্বলভাবে দেখার সুযোগ করে দেয় বহু দূর থেকে আসা আলোর চলার পথ বাঁকিয়ে দিয়ে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো জেমস ওয়েবের উচ্চ রেজ্যুলুশনে অবলোহিত আলো বিশ্লেষণের ক্ষমতা। এই দুইয়ে মিলেই হয়েছে বাজিমাত।

এ প্রসঙ্গে কার্তিক আইয়ার বলেন, ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং না ঘটলে আমরা এই গ্যালাক্সি বিশ্লেষণ করতে পারতাম না। তাত্ত্বিকভাবে এর কথা আমরা জানি, আগেও এরকম অনেক কাজ হয়েছে। তবু নিজে এই মহাকর্ষীয় লেন্সিং প্রত্যক্ষ করাটা সত্যি বিস্ময়কর।’

সর্বপ্রথম লামীয়া মওলা জেমস ওয়েবের তোলা অসংখ্য গ্যালাক্সির ছবির মধ্য থেকে এ গ্যালাক্সি চিহ্নিত করেন। রাতের আকাশে উজ্জ্বল তারার গুচ্ছ দেখে তিনিই এর নাম দেন ফায়ারফ্লাই স্পার্কল বা জোনাকির ঝাঁক।

ফায়ারফ্লাই স্পার্কলের খুব কাছেই সঙ্গী হিসেবে রয়েছে আরও দুটি গ্যালাক্সি। এর প্রথমটি মাত্র ৬ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে। আর দ্বিতীয় সঙ্গীটি রয়েছে ৪২ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। উদাহরণস্বরূপ, তুলনা করে বলা যায়, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিটির ব্যাস প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ—অর্থাৎ তিনটি গ্যালাক্সি (ফায়ারফ্লাই ও এর দুই সঙ্গী) একসঙ্গে এই ব্যাসের মধ্যে এঁটে যাবে। গবেষকদের ধারণা, এই গ্যালাক্সিগুলো পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করছে।

বর্তমানের সবচেয়ে শক্তিশালী দুরবিন—জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প। নাসা, তার সহযোগী সংস্থা ইসা (ইউরোপীয়ান স্পেস অ্যাজেন্সি) ও সিএসএ (কানাডিয়ান স্পেস অ্যাজেন্সি) এটি যুগ্মভাবে পরিচালনা করছে।

সোর্স: জুম বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button