বাংলাদেশ

সিলেটে যে কারণে ‘ব্যতিক্রম’ আরিফ

সম্প্রীতির সিলেটে মাইক হাতে নিয়ে ট্রাকে করে বেরিয়ে পড়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। সিলেটের সাবেক মেয়র তিনি। চারদিকে ক্ষোভ, অনিশ্চয়তা
ও ভাঙচুর। হচ্ছে লুটপাটও। আগুন জ্বলছে অনেক জায়গায়। তখন কেউ একজনকে খুঁজছিলেন সিলেটের মানুষ। যিনি এগিয়ে আসবেন। ধরবেন হাল। দেবেন সান্ত্বনা। কিন্তু কার এত সাধ্য ক্ষোভের জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দেয়ার।

এমনই একজন সিলেটের সাবেক মেয়র ও বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী। নির্বাচন হলেও দায়িত্ব হস্তান্তর না করায় গেল বছরের এই দিনেও ছিলেন মেয়র। নির্বাচন না করে মেয়রের চেয়ার ছেড়েছেন ৯ মাস আগে। কিন্তু নগরের মানুষকে ভুলেননি তিনি। ৫ই আগস্ট। সিলেটের রাজপথ লাখো জনতার দখলে। পুলিশ নেই। কোনো কন্ট্রোল নেই। বিজয়ী জনতার দীর্ঘ ক্ষোভের ঢেউয়ে চারদিক একাকার। তখন নিজ বাসাতেই ছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী।

বসে থাকলেন না। সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীদের নিয়ে শরিক হলেন বিজয় মিছিলে। দিলেন নেতৃত্বও। নগরের কোর্ট পয়েন্টে সিলেট বিএনপি’র নেতাকর্মীদের যে সমাবেশ হয়েছিল সেখানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি ছিল। মধ্যমণি ছিলেন সাবেক এই মেয়র। নগরের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর দেখে সমাবেশেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। ক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত থাকার নির্দেশনা দিলেন। কাজও হলো। ঘরে ফিরতে শুরু করলেন মানুষ। কিন্তু দুর্বৃত্তরা দমে যায়নি। নগর জুড়ে শুরু করে লুটপাট। অরাজকতা শুরু করে সরকারি স্থাপনায়ও। সবেমাত্র কোর্ট পয়েন্টের সমাবেশ শেষ করে বাসায় ফিরেন আরিফ। এমন সময় আসতে থাকে লুটপাট ও অরাজকতার খবর।

বসে থাকেননি। বাসায় থাকা বিএনপি’র সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে খোলা ট্রাকে মাইক হাতে বেরিয়ে পড়েন। লুটপাটকারীদের সরাসরি দুর্বৃত্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে নগরবাসীকে আহ্বান করেন। তার ডাকে সাড়া দেন অনেকেই। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে শান্ত করতে ব্যবসায়ী, সাংবাদিক সহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বেরিয়ে আসেন। জেলা ও নগর বিএনপি’র নেতাকর্মীরাও যে যার মতো ট্রাকে, অটোরিকশা, রিকশাযোগে দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে নামেন।

সরকারি সম্পদ ঠেকাতে প্রতিরোধের দেয়াল গড়েন। এতে হয়েছে কাজও। কারণ; যেভাবে সিলেট নগরে লুটপাট শুরু হয়েছিল আরিফুল হক চৌধুরী সহ বিএনপি নেতারা মাঠে না নামলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। নগরের বৃহত্তর কুয়ারপাড় এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন; রাতে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সহ বিএনপি’র কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা এসেছিলেন।

তখন ওই এলাকার মানুষের মধ্যে বিরাজ করছিল ভয় ও আতঙ্ক। তিনি এসে সবাইকে ডাকেন। বলেন; পুলিশ মাঠে নেই। নিজেরা দলে দলে এলাকায় পাহারা দেন। কেউ যেনো লুটপাট ও অরাজকতা চালাতে না পারে সেদিকে নজর রাখার নির্দেশ দেন। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের দিকে নজর রাখার তাগিদ দেন। শুধু কুয়ারপাড় নয়, ওই দিন মধ্যরাত পর্যন্ত নগরের অন্তত ২০টি এলাকায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেন সাবেক এই মেয়র।

ওই দিন তার সঙ্গে থাকা এসিড সন্ত্রাস নির্মূল কমিটি-এসনিকের সাধারণ সম্পাদক জুরেজ আব্দুল্লাহ গুলজার জানান- টানা দু’দিন আরিফুল হক চৌধুরী গোটা নগর চষে বেরিয়েছেন। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আস্থা ফিরে আনতে তিনি পাড়ায় পাড়ায় যান। তখন সংখ্যালঘুদের মধ্যে আস্থার সংকট ছিল। সাবেক এই মেয়রকে কাছে পেয়ে তাদের শঙ্কা কাটে। জুরেজ জানান; সরকার পতনের পর অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছিল। গোটা নগর জুড়ে ছিল ময়লার ভাগাড়। নগর ভবনে আসতে ভয় পাচ্ছিলেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এ দৃশ্য দেখে আরিফুল হক চৌধুরী চলে যান নগর ভবনের সামনে। সেখানে বিএনপি’র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি আবর্জনা অবসারণের কাজ শুরু করেন। আহ্বান জানান; কাউন্সিলরদের মাঠে নামার। তার আহ্বানে আশ্বস্ত হন কাউন্সিলর, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা। দুপুরের পরপরই তারা কাজে ফিরেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে নাগরিক সেবা শুরু হয়। পুলিশের কার্যক্রম নেই। থানা খালি। আরিফুল হক চৌধুরী সেখানেও রাখলেন ভূমিকা। বিশেষ করে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। নানা ভাবে সহায়তা, আশ্বাস দিলেন। নিজেও পরিদর্শন করলেন জ্বালিয়ে দেয়া কয়েকটি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি।

ভড়কে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের আশ্বাস দিলেন। জনগণের পাশে থাকার কথাও বলেছেন। সিলেটের সম্প্রীতিময় রাজনীতিতে এক সময় সবার আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় ছিলেন সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। নগরের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সুদিন, দুর্দিনের বন্ধু। সেই ধারাবাহিকতা এবার সিলেটের সম্প্রীতির রাজনীতিতে উদাহরণ হলেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। মানবজমিনকে জানিয়েছেন- এই সিলেট আমাদের সবার।

এখানে দলমত সবাই আছে। কিন্তু সিলেটের ধর্মীয়, রাজনৈতিক সম্প্রীতি দেশের অন্য এলাকার চেয়ে ভিন্ন। আমাদের পূর্ব পুরুষ এই সম্প্রীতি রক্ষা করে গেছেন। এখন আমাদের কর্তব্য সম্প্রীতির পাশাপাশি মানুষের জানমাল রক্ষা করা। সেটি আমরা দায়িত্ব থেকে করেছি। এতে বাহবা কুড়ানোর কিছুই নেই। জুলাই শেষার্ধ থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত সিলেটে যে জানমালের ক্ষতি হয়েছে সেটি আমরা রক্ষা করতে পারিনি। বিশেষ করে সিলেটের রাজপথে এবার ক্যাডারদের অস্ত্রবাজি নগরবাসীর মনে দাগ কেটেছে। সেটির চেষ্টা করলে আমরা রাজনীতিবিদরা এড়িয়ে যেতে পারতাম। এরপরও বলবো; এই সিলেট আধ্যাত্মিক শহর। সিলেটের মানুষ কারও চোখ রাঙানির কাছে মাথা নত করে না, সেটি এবারো তারা দেখিয়ে দিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button