বাংলাদেশ

ছোট লোভও সামলাতে পারেননি সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল মিয়া

ছোট লোভও সামলাতে পারেননি সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল মিয়া

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন রাজনীতিবিদ, অনুগত ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও। টাকার অঙ্কে তাদের দুর্নীতির হিসাব কোটিতে সীমাবদ্ধ নেই, হাজার কোটি পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। হাসিনা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের এমনো কেউ আছেন, যারা ছোট লোভও সামলাতে পারেননি। তাদেরই একজন পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব থেকে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করা এই কর্মকর্তা সর্বত্র ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তদন্ত হলে তার বিরুদ্ধে হয়তো অনেক বড় দুর্নীতির প্রমাণ বেরিয়ে আসবে; কিন্তু ছোট একটি অনুসন্ধানে যা বেরিয়ে এসেছে, তাও বিস্ময়কর। তোফাজ্জল হোসেন মিয়া নিজের বাবার নামে একটি অস্তিত্বহীন এতিমখানা দেখিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

তথ্য বলছে, তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায়। সেখানে বাবার নামে একটি এতিমখানা দেখিয়ে হাতিয়ে নেন সরকারি অর্থ বরাদ্দ। বছরের শুরুতে সেই এতিমখানায় বরাদ্দ নেওয়া হলেও তখন এটির নিবন্ধনও ছিল না। চলতি বছরের জুন মাসে নেওয়া হয় নিবন্ধন। স্থানীয়রা বলছেন, এই নামে কোনো এতিমখানা নেই। সরেজমিন ঘুরে এতিমখানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

নথিপত্র বলছে, চলতি বছরের ৬ জুন পিরোজপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে একটি এতিমখানার নিবন্ধন দেওয়া হয়। ভান্ডারিয়া উপজেলা সদরে এই এতিমখানার অবস্থান। যার নাম আলহাজ আজহার উদ্দিন মিয়া এতিমখানা। আজহার উদ্দিন পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার বাবা। এতিমখানার সভাপতি হিসেবে রয়েছেন মুখ্য সচিবের আপন বড় ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন মিয়া।

এতিমখানা নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে কিছু নিয়ম রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে এতিমখানার নিজস্ব ভবন এবং জমি থাকতে হবে। এ ছাড়া পর্যাপ্তসংখ্যক এতিম শিক্ষার্থী থাকতে হবে। কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসবের কিছুই নেই। এতিমখানাটির নিবন্ধন জুন মাসে নেওয়া হলেও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রায় একশ এতিম শিশু দেখিয়ে অর্থ বরাদ্দ নেওয়া হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ক্যাপিটেশন বরাদ্দ দেওয়ারও কিছু বিধান রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধনকৃত বেসরকারি এতিমখানার নীতিমালার ৭.১২-এর আলোকে ন্যূনতম ১০ জন এতিম অবস্থান করে—এই রকম প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এতিমের জন্য বরাদ্দ অনুমোদন (ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট) দেওয়ার সুযোগ বিদ্যমান রয়েছে। এ ছাড়া নিজস্ব জায়গায় এতিম প্রতিপালনের উপযোগী বাসস্থান থাকারও বিধান রয়েছে। কিন্তু তথ্য বলছে, এতিমদের জন্য অর্থ বরাদ্দ নেওয়ার সময় এতিমখানার নিবন্ধনও ছিল না। কিন্তু সমাজসেবা কার্যালয়ের নথি বলছে, এতিমখানায় একশ এতিম শিক্ষার্থী রয়েছেন, সেই অনুপাতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, ভান্ডারিয়ায় শাহাবুদ্দিন কামিল মাদ্রাসা নামে একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এ মাদ্রাসা দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালায় তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার পরিবার। মাদ্রাসার সভাপতি করা হয় তার ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন মিয়াকে। স্থানীয়রা অভিযোগে বলেন, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান রয়েছে, সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে শাহাবুদ্দিন নামে একজন দানশীল ব্যক্তির নামেই মাদ্রাসার নামকরণ করা হয়। যার দেওয়া জমিও রয়েছে এই মাদ্রাসায়। এই মাদ্রাসার দিকে নজর পড়ে তোফাজ্জল মিয়ার। তিনি চেষ্টা চালান নিজের বাবার নামে মাদ্রাসাটির নামকরণ করতে। সেই আলোকেই মাদ্রাসার সভাপতির দায়িত্ব নেন তার বড় ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন মিয়া। অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ এবং কেনাকাটায় নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। তথ্য বলছে, এই মাদ্রাসা ভবনকে এতিমখানা ভবন দেখিয়েই সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে এতিমখানার নামে নিবন্ধন নেওয়া হয়। এর আগে থেকেই এতিমখানার নামে বিভিন্ন স্থান থেকে অনুদান সংগ্রহ করত মুখ্য সচিবের পরিবার। সর্বশেষ একশ এতিম দেখিয়ে ১২ লাখ টাকা সরকারের বরাদ্দও নেন অস্তিত্বহীন এ এতিমখানার নামে।

সরেজমিন এতিমখানার ঠিকানায় দেখা যায়, সেখানে রয়েছে শাহাবুদ্দিন কামিল মাদ্রাসা ভবন। এতিমখানার কোনো অস্তিত্ব নেই। মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক এবং কর্মচারীরা জানিয়েছেন, স্বৈরাচার সরকারের পতনের পরে কামিল মাদ্রাসার ভবনের একটি কক্ষে মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী থাকা শুরু করেন। তারা এতিম নয়। তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার আপন ভাই এতিমখানার সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের এক আত্মীয় মো. নজরুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, তোফাজ্জেল মিয়ার ভাই ছাড়াও এসব অর্থ আত্মসাতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং তার আত্মীয় নজরুল ইসলাম জড়িত রয়েছেন।

জানতে চাইলে পিরোজপুর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ইকবাল কবির কালবেলাকে বলেন, ‘আসলে মুখ্য সচিব তো রাষ্ট্রের দুজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার মধ্যে একজন। এখন আমরা তো ছোট অফিসার, আমি এখন কী বলব বলেন।’

অস্তিত্বহীন এই মাদ্রাসার বিষয়টি কি আপনারা পরিদর্শন করে অর্থ ছাড় করেছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা তো পরিদর্শন করে এমনটা দিই না। মুখ্য সচিব স্যারের পিএস ফোন দিয়ে বলেছিল। তারা একটি মাদ্রাসায় তাদের এতিমখানা দেখিয়েছিল। বলেছিল আপাতত ওখানে (এতিম) আছে, পরে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হবে। এভাবেই ওটা (বরাদ্দ) দেওয়া হয়েছে।’

মাদ্রাসার শিক্ষক মাহফুজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘তারা অনুদান (ক্যাপিটেশন) বরাদ্দ পেয়েছে জুন মাসে। আর টাকা তুলেছে জানুয়ারি থেকে হিসাব করে। এখানে কোনো স্বচ্ছতা নেই। মাদ্রাসায় কোনো বোডিং নেই, ছাত্র নেই। এতিমখানা করতে গেলে আলাদা জমি লাগে, তা-ও তাদের নেই। এখানে সচিব মহোদয়ের একটা নির্দেশনা ছিল। সচিব যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন জোর করে ভান্ডারিয়া কামিল মাদ্রাসার ভবন দেখিয়ে এটা করেছেন।’

ছাত্র-জনতা হত্যায় তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপনে আছেন। এ কারণে বক্তব্য নিতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে।

মুখ্য সচিবের আপন বড় ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন মিয়াকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।

সূত্র: dailycomillanews

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button