বাংলাদেশ

মহাবিশ্ব প্রসারণশীল: রাতের আকাশের অন্ধকার রহস্যের সমাধান

রাতের আকাশ কালো বা গাঢ় অন্ধকার থাকবে, সেটিই আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি। মানুষ তার জন্মের পর থেকে চোখের সামনে দেখে আসা জলজ্যান্ত এমন প্রমাণকে অবিশ্বাস করে কীভাবে। কিন্তু সতেরো শতকে সেটা নিয়েই অবাক হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাঁদের একজন জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার। সে যুগের নামকরা বিজ্ঞানী। গ্রহের গতিসংক্রান্ত সূত্র আবিষ্কার করে বেশ নাম করেছিলেন তিনি।

১৬১০ সালের দিকে জোহানেস কেপলার যুক্তি দেখালেন, মহাবিশ্ব যদি অগণিত নক্ষত্র নিয়ে সব দিকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবী থেকে মহাকাশের যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, আমাদের দৃষ্টিসীমা কোনো না কোনো নক্ষত্রে গিয়ে ঠেকবে। উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর মাঝখানে ম্লান হলেও কোনো না কোনো নক্ষত্র থাকবে। আবার ম্লান নক্ষত্রগুলোর মাঝখানেও থাকবে কোনো না কোনো ম্লানতর নক্ষত্র।

কাজেই মহাকাশের নক্ষত্রগুলোর মাঝখানে কোনো শূন্যস্থান থাকবে না। অনেকটা বনের ভেতর চারদিকে গাছ দেখার মতো। বনের ভেতর যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, আমাদের দৃষ্টিসীমা কোনো না কোনো গাছে গিয়ে ঠেকে। তাই ঘন বন ভেদ করে আমরা বাইরে কিছু দেখতে পাই না। তেমনি পৃথিবী থেকে আমাদের দৃষ্টিসীমাও যদি এভাবে কোনো না কোনো নক্ষত্রে গিয়ে ঠেকে, তাহলে গোটা রাতের আকাশ সাধারণ মানের কোনো নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হওয়ার কথা। মোদ্দাকথা, রাতের আকাশ উজ্জ্বল হওয়া উচিত, কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণে ঘটে ঠিক উল্টোটা, অর্থাৎ রাতের আকাশ অন্ধকার দেখা যায়। বড়ই রহস্যময় ব্যাপার! কিন্তু এ রকম হওয়ার কারণ কী?

কেপলারের এই প্রশ্নে জন্ম হলো একটি প্যারাডক্সের। কিছুদিন পর নিউটনের বন্ধুস্থানীয় অ্যাডমন্ড হ্যালিও একই প্রশ্ন তুললেন। হ্যালির ধূমকেতুর জন্য যিনি বিখ্যাত। তবে এই প্যারাডক্স বিজ্ঞানীদের কাছে জনপ্রিয় হলো জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিখ অলবার্সের কারণে। উনিশ শতকের শুরুতে, মানে ১৮২৩ সালের দিকে তিনি ব্যাপকভাবে প্রচার করেন সেটি। তাই সবার কাছে এটি অলবার্সের প্যারাডক্স নামে পরিচিত হয়ে উঠল।

এরপর দীর্ঘকাল প্যারাডক্সটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে, ভ্রু কুঁচকে বারবার রাতের আকাশের দিকে তাকিয়েছেন জ্যোতির্বিদেরা, কিন্তু কেউ কোনো সমাধান দিতে পারেননি। অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই বিজ্ঞানের বইয়ে ঠাঁই করে নিল কয়েক দশক।

মজার ব্যাপার হলো, প্যারাডক্সটা প্রথম যিনি সমাধান করেন, তিনি কোনো বিজ্ঞানী নন। কবি ও কথাসাহিত্যিক। তাঁকে মার্কিন রহস্যকাহিনির জনকও বলেন কেউ কেউ। তিনি অ্যাডগার অ্যালান পো। নিজের লেখা রহস্যকাহিনির মতোই রহস্যময় এক চরিত্র।

১৮৪৮ সালে ‘ইউরেকা’ নামে কিছু গদ্য লেখেন পো। সেখানেই ছিল অলবার্স প্যারাডক্সের সমাধান। মহাবিশ্ব নির্দিষ্ট সময় জন্ম নিয়েছে এবং তা প্রসারণশীল বলে ইঙ্গিত করেছেন পো। কিন্তু কথাসাহিত্যে পো যতই নাম কামান, বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর কোনো কদর ছিল না। আবার এর পেছনে কোনো প্রমাণও ছিল না তাঁর কাছে। বিজ্ঞানজগতে উটকো ধরে নিয়ে তাঁর কথাগুলোকে কেউ পাত্তা দিলেন না। পাত্তা দেবেনই–বা কীভাবে, যুগ যুগ ধরে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে, মহাবিশ্ব স্থির, চিরন্তন; সেখানে পো বলছেন একেবারে উল্টো কথা।

দীর্ঘ প্রায় ৮০ বছর পর অ্যালান পোর কথাটাকেই সত্য বলে প্রমাণ করলেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবল। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসনে সে যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন হাবল। ১০০ ইঞ্চির প্রতিফলক টেলিস্কোপ ছিল সেটা।

রাতের পর রাত জেগে দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর অসংখ্য ছবি তোলেন হাবল। সেগুলো বিশ্লেষণ করে মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন, যুগান্তকারী আবিষ্কার করে বসেন। হাবলের পর্যবেক্ষণে সিংহভাগ গ্যালাক্সির আলোতে লোহিত বিচ্যুতি পাওয়া গেল। তার সরল অর্থ, গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে একগুচ্ছ তথ্য–উপাত্ত দিয়ে হাবল প্রমাণ করলেন, মহাবিশ্ব স্থির বা শাশ্বত নয়, বরং তা ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে।

এ রকম সাক্ষ৵–প্রমাণ হাজির করার পর কারো আর বিষয়টি অস্বীকার বা অবিশ্বাস করার উপায় রইল না। খোদ আইনস্টাইনকেও তাই আফসোস করতে হলো প্রায় এক দশক পর। কারণ, একদিন নিজের সমীকরণ থেকে পাওয়া গতিশীল মহাবিশ্বের কথা অবিশ্বাস করেছিলেন তিনি। মহাবিশ্বকে স্থির করতে তাতে জোড়াতালি দিয়ে মহাজাগতিক ধ্রুবকও ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন জোর করে।

একবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে সস্ত্রীক বেড়াতে যান ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসনে। হাবলের সব প্রমাণ নিজের চোখে দেখেন। তারপর হার স্বীকার করে নেন। সেখানেই এক সংবাদ সম্মেলনে একে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে স্বীকার করে নেন এই জার্মান বিজ্ঞানী। নিশ্চয়ই ভাবছেন, কিন্তু গতিশীল মহাবিশ্বের সঙ্গে অলবার্স প্যারাডক্সের সম্পর্কটা কী? এখান থেকে সমাধানটাই-বা আসে কীভাবে? চলুন, সেটাই জানা যাক।

সোর্স: জুম বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button