যে নারীর উদ্ভাবিত ডিশওয়াশিং মেশিন এখন ঘরে ঘরে

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : ১৮৯৩ সাল। ছয় মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আয়োজিত হয়েছিল শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ আয়োজন ওয়ার্ল্ডস কলম্বিয়ান এক্সপোজিশন। এই আয়োজনে এসেছিল ২ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ। মেশিনারি হলে আয়োজিত এই মেলায় হাজারো নতুন যন্ত্রপাতির প্রদর্শিত হয়েছিল। ফোনোগ্রাফ-টেলিগ্রাফের মতো যন্ত্রের মিছিলে এই প্রদর্শনীতে আলোড়ন তুলেছিল একটি ডিশওয়াশিং মেশিন।
ডিশওয়াশিং যন্ত্রটি দিয়ে একসঙ্গে ২০০ টিরও বেশি থালা-বাসন ধোয়া যেত। ডিশওয়াশিং মেশিনে দেওয়ার মাত্র দুই মিনিটের মধ্যেই থালা-বাসন ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে আসত। বিশাল এই মেলায় এই ডিশওয়াশিং মেশিনটি শুধু প্রদর্শনের জন্যই ছিল না, পাশাপাশি মেলার রেস্তোরাঁগুলো প্রতিদিন হাজার হাজার থালা-বাসন পরিষ্কার করতে এটি ব্যবহার করেছিল। এমনকি মেলায় ‘সেরা যান্ত্রিক নির্মাণ, স্থায়িত্ব এবং নির্দিষ্ট কাজে উপযোগিতার’ জন্য পুরস্কারও পেয়েছিল এই যন্ত্র।
জেনে অবাক হবেন যে, এই ডিশওয়াশিং মেশিনের উদ্ভাবক ছিলেন একজন নারী এবং ওই বিশাল আয়োজনের একমাত্র নারী উদ্ভাবক। চলুন তাঁর সম্পর্কে জানা যাক। প্রকৌশলী লরেন বুশের লেখা ওউম্যান ইন দ্য ন্যাশনাল ইনভেন্টরস হল অব ফেম বইয়ে এই নারী উদ্ভাবককে নিয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে।
জোসেফিন গারিস কোক্রান। ১৮৩৯ সালের এক শীতল মার্চের দিনে ওহাইওর অ্যাশতাবুলা কাউন্টিতে জন্ম হয় তাঁর। পূর্বসূরিদের থেকে পেয়েছিলেন উদ্ভাবনী দক্ষতা। প্রথম স্টিমবোটের তৈরির পেটেন্ট পেয়েছিলেন প্রপিতামহ। বাবা ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যিনি ওহাইও ও ইন্ডিয়ানায় একাধিক চূর্ণীকল (মিল) পরিচালনা করতেন।
মায়ের মৃত্যুর পর জোসেফিন বড় বোনের সঙ্গে ইলিনয়ে চলে আসেন, যেখানে তাঁর পরিচয় হয় উইলিয়াম কোক্রানের সঙ্গে। জীবন নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়ানো উইলিয়ামের সঙ্গে বেশ সখ্যতা হয় জোসেফিনের। ইলিনয়ে ড্রাই গুডস ব্যবসা ছিল উইলিয়ামের। ১৮৫৮ সালে ১৯ বছর বয়সী জোসেফিন নয় বছরের বড় উইলিয়াম কোক্রানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
স্বাধীনতাপ্রিয় জোসেফিন সফল এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী হিসেবে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন পার করছিলেন। ইলিনয়ের শেলবিভিলে একটি বড় বাড়িতে বসবাস শুরু করেন এই দম্পতি। জোসেফিন প্রায়ই অতিথিদের আপ্যায়নে তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ১৭শ শতাব্দীর চিনামাটির বাসন ব্যবহার করতেন। তবে বাসন ধোয়ার সময় গৃহপরিচারকেরা ভেঙে ফেলেছে দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। পরে নিজেই বাসন ধোয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তাঁর হাত থেকে পড়েও প্লেট ভেঙে যায়।
এ অবস্থায় জোসেফিন ভাবতে থাকেন, এ কাজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যায় কি না। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘যদি অন্য কেউ ডিশওয়াশিং মেশিন আবিষ্কার না করে, তবে আমি নিজেই এটি করব।’
প্রদর্শনীতে আলোড়ন তুলেছিল একটি ডিশওয়াশিং মেশিন। ছবি: শিকাগো মিউজিয়াম।এমন অবস্থায় ১৮৮৩ সালে উইলিয়াম হঠাৎ মারা গেলে জোসেফিন জানতে পারেন, তাঁদের আর্থিক অবস্থা আসলে তাঁর ধারণার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। উইলিয়াম মাত্র ১৫০০ ডলার এবং ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা রেখে মারা গিয়েছিলেন। জোসেফিন এ সময় তাঁর ডিশওয়াশিং মেশিন তৈরি পরিকল্পনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন।
এ কাজে তাঁর সহযোগী হন মেকানিক জর্জ বাটারস। জোসেফিনের আঁকা নকশা থেকে একটি কার্যকর প্রোটোটাইপ তৈরি করতে কাজ করেন তিনি। লরেন বুশ তাঁর বইয়ে লেখেন, ‘তাদের কাজের সম্পর্ক অত্যন্ত সফল ছিল, কারণ বাটারস তাঁকে গুরুত্ব সহকারে নিতেন। তিনি জানতেন, তাঁর কাজ কেবল জোসেফিনের ধারণাগুলোর বাস্তবায়ন করা।’
লোকচক্ষু এড়িয়ে জোসেফিন ও বাটারস বাড়ির পেছনে শেডে কাজ করতেন। বুশ বলেন, ‘জোসেফিন খুব সচেতন ছিলেন। মানুষ যদি বারবার তাঁর বাড়িতে বাটারসকে আসতে দেখত, তবে এটি তার সামাজিক মর্যাদার জন্য ক্ষতিকর হতে পারত।’
১৮৮৬ সালের বড়দিনের কয়েকদিন পরেই, জোসেফিন ‘ডিশ ওয়াশিং মেশিন’ এর জন্য মার্কিন পেটেন্ট নম্বর পান। জোসেফিনের আশা ছিল, তাঁর এই উদ্ভাবন নারীদের কাজের বোঝা কমাতে সাহায্য করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, যন্ত্রটির দাম এত বেশি দাঁড়ায় যে সাধারণ ঘরের নারীদের সাধ্যের মধ্যে ছিল না।
এক সাক্ষাৎকারে জোসেফিন বলেন, ‘যখন রান্নাঘরের জন্য ৭৫ থেকে ১০০ ডলার খরচের কথা আসে, তখন একজন নারী সঙ্গে সঙ্গে হিসাব কষতে বসে যান যে এই অর্থ দিয়ে আর কী কী করা সম্ভব। তিনি বাসন ধোয়া অপছন্দ করেন—কোনো নারীই বা পছন্দ করেন?—কিন্তু তিনি এখনো তাঁর সময় ও স্বাচ্ছন্দ্যকে অর্থমূল্য হিসেবে ভাবতে শেখেননি। তাছাড়া, বাড়ির বড় খরচের ক্ষেত্রে শেষ সিদ্ধান্ত নারীর হাতে থাকে না।’
তারপর জোসেফিন নারীদের গৃহের ব্যবহারের ভাবনা দূরে রেখে হোটেল ও রেস্তোরাঁর দিকে মনোযোগ দেন। অবশেষে ১৮৮৭ সালে শিকাগোর পামার হাউস হোটেলে তাঁর প্রথম ডিশওয়াশিং মেশিন বিক্রি করতে পারেন।
পুরুষ হোটেল মালিকদের কাছে নিজের ধারণা উপস্থাপন করা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, সে স্মৃতি মনে করে জোসেফিন বলেন, ‘আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না সেই সময় কেমন ছিল…একজন নারীর জন্য একা একটি হোটেলের লবিতে প্রবেশ করাই ছিল দুঃসাহসিক কাজ। আমি কখনো আমার স্বামী বা বাবাকে ছাড়া কোথাও যাইনি। লবিটা যেন এক মাইল চওড়া মনে হচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল আমি অজ্ঞান হয়ে যাব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। বরং আমি ৮০০ ডলারের একটি অর্ডার পেয়েছিলাম।’
জোসেফিনের করা ডিশওয়াশিং মেশিনের পেটেন্ট। ছবি: ইউএস পেটেন্ট অফিস।জোসেফিন পরে গারিস-কোক্রান নামে ডিশওয়াশিং কোম্পানি গড়ে তোলেন। ১৮৯৩ সালের শিকাগো ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার তাঁর জন্য বড় সাফল্য নিয়ে আসে। একমাত্র নারী উদ্ভাবক হিসেবে মেলায় তিনি সবার মনোযোগ কাড়েন। আগের থেকে অনেক বেশি অর্ডার আসতে থাকে তাঁর। রেস্তোরাঁ ও হোটেলগুলোর পাশাপাশি হাসপাতালগুলোও তাঁর থেকে ডিশওয়াশার কেনা শুরু করে।
১৮৯৮ সালের দিকে জোসেফিন ডিশওয়াশার তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি নিজের কারখানায় শুরু করেন। কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ‘ক্রেসেন্ট ওয়াশিং মেশিন কোম্পানি’ রাখেন। নিজস্ব কারখানা চালু করার পর তিনি সেই শুরুর সময়ের সঙ্গী বাটারসকে পদোন্নতি দিয়ে ফোরম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। কোম্পানি বড় হতে থাকে। ইলিনয় ছাড়িয়ে, আলাস্কা থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত পৌঁছে যায় জোসেফিনের ডিশওয়াশার।
১৯১৩ সালের ৩ আগস্ট ৭৪ বছর বয়সে শিকাগোতে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সফল নারী উদ্ভাবক জোসেফিন ক্রোকান। তাঁর মৃত্যুর ১৩ বছর পর হোবার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ক্রেসেন্ট ডিশওয়াশিং কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে। জোসেফিনের মূল পেটেন্টের ওপর ভিত্তি করে কিচেনএইড ডিশওয়াশার উৎপাদন শুরু করে। ১৯৮৬ সালে হোবার্টের কিচেনএইড ব্র্যান্ডটি হুইরপুল কর্পোরেশন অধিগ্রহণ করে।
প্রকৌশলী লরেন বুশ বলেন, “এটি আশ্চর্যের বিষয়, এখন এই আধুনিক যুগে যেসব ডিশওয়াশার তৈরি হচ্ছে সেগুলোর সঙ্গে জোসেফিনের আবিষ্কৃত ডিশওয়াশারের এক ‘অবিচ্ছিন্ন সংযোগ’ রয়ে গেছে।”
সোর্স: জুম বাংলা