লিচু গাছে মুকুল নেই, ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা

জুমবাংলা ডেস্ক : ফাল্গুন মাস এলেই ঈশ্বরদীর প্রতিটি গ্রামজুড়ে লিচুর মুকুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। শত শত লিচু বাগানে থোকায় থোকায় হলুদ রঙের মুকুলে ছেয়ে যায় চারপাশ। কিন্তু এবার চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। লিচু গাছে মুকুল নেই বললেই চলে, আর সেই চিরাচরিত মুকুলের সুগন্ধও উধাও। ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কায় বাগান মালিক, চাষি ও ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। লিচুর মুকুলের এমন করুণ দশা গত পাঁচ দশকে কেউ দেখেনি। সময় সংবদের করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
লিচু ঈশ্বরদীর প্রধান অর্থকরী ফসল। প্রতিবছর এ উপজেলায় ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার লিচু উৎপাদিত হয়। লিচু চাষের ওপর নির্ভর করে লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা। কিন্তু এবারের মুকুল সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা। তাদের মতে, আবহাওয়াজনিত কারণেই লিচু গাছে মুকুল কম এসেছে। তবে উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এখনো কিছুটা সময় রয়েছে, এবং ইতোমধ্যে কিছু গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে।
বাগানে মুকুলের বদলে নতুন পাতা
উপজেলার লিচু চাষের জন্য পরিচিত মানিকনগর, মিরকামারী, চরমিরকামারী, কদিমপাড়া ও আওতাপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, শত শত লিচু গাছে মুকুলের পরিবর্তে নতুন পাতা গজিয়েছে। গাছে নতুন পাতা গজালে মুকুল আসার সম্ভাবনা কমে যায়। এতে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা আরও বেড়ে গেছে। ফাল্গুন মাসের ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও চাষিরা এবার লিচু বাগানের পরিচর্যা করছেন না। বাগানে সার, কীটনাশক বা মুকুল বৃদ্ধির ওষুধও ব্যবহার করছেন না। ফলে যেখানে অন্যান্য বছর এ সময় চাষিরা ব্যস্ত থাকতেন, এ বছর বাগানগুলো পড়ে আছে নীরব-নিস্তব্ধ।
চাষিরা বলছেন, যেখানে ১০০টি লিচু গাছ থাকলে স্বাভাবিক সময়ে ৯০-৯৫টি গাছে মুকুল আসার কথা, সেখানে এবার ১০ থেকে ২০টি গাছে মুকুল এসেছে। তাও আবার খুবই অল্প পরিমাণে। অতীতে এত কম মুকুল কখনো দেখা যায়নি বলে তারা জানান।
কৃষকের দুশ্চিন্তা: লিচু উৎপাদন বিলুপ্তির পথে?
লিচু চাষে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক আব্দুল জলিল কিতাব ওরফে লিচু কিতাব বলেন, ‘আমি ৪৫ বছর ধরে লিচুর আবাদ করছি। এমন বিপর্যয় কখনও হয়নি। শুধু আমার নয়, পুরো বাংলাদেশেই লিচু চাষের এ অবস্থা। প্রধান কারণ হলো বৈরী আবহাওয়া। পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আগামীতে লিচুর ভালো আবাদ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এ বছর হয়ত শতকরা ১০ শতাংশ লিচুর ফলনও পাওয়া যাবে না। লক্ষাধিক মানুষ লিচুর চাষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এরা সবাই এবার বড় সংকটে পড়বে। সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, না হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে লিচু চাষ বিলুপ্তির পথে চলে যাবে।’
মানিকনগর গ্রামের বাগান মালিক নায়েব মুন্সী বলেন, ‘এ অঞ্চলে এবার লিচুর মুকুল নেই বললেই চলে। দুই-একটি গাছে মুকুল দেখা গেলেও বেশির ভাগ গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে। আমি এবং আশপাশের অনেকেই লিচু চাষের ওপর নির্ভর করি। এবার লিচুর ফলন না হলে আমাদের বড় ধরনের অর্থসংকটে পড়তে হবে।’
একই গ্রামের লিচু চাষি লিটন বিশ্বাস বলেন, ‘আমার জীবনে কখনো এত কম লিচুর মুকুল দেখিনি। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ লিচু চাষের ওপর নির্ভরশীল। এবার আমাদের জীবন চালানো কঠিন হয়ে যাবে। ১০-২০ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছে, বাকিগুলো একেবারেই খালি।’
লিচু চাষি মোস্তাফা জামান নয়ন বিশ্বাস বলেন, ‘বিগত ৫০ বছরে লিচুর এমন বেহাল দশা দেখিনি। আমরা যারা চাষি, সবাই দুশ্চিন্তায় আছি। শুধু চাষিরাই নয়, লিচুর সঙ্গে জড়িত দিনমজুর, সার-কীটনাশক ব্যবসায়ী, লিচু ব্যবসায়ী, ভ্যানচালক—সবাই সংকটে পড়বে। আমাদের কী হবে বুঝতে পারছি না।’
কৃষি বিভাগের বক্তব্য
ঈশ্বরদী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, ‘ঈশ্বরদী লিচু চাষের জন্য বিখ্যাত। এ বছরও ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় মুকুলের পরিমাণ কম। আমরা মনে করছি, বৈরী আবহাওয়ার কারণেই এই সংকট তৈরি হয়েছে। তবে কিছু গাছে মুকুল আসা শুরু করেছে, আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি যাতে যতটুকু মুকুল এসেছে তা রক্ষা করা যায়।’
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর কুমার দাস বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর লিচুর মুকুল কম এসেছে। এ কারণে চাষিরা হতাশ। কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি, তারা যেন মাঠপর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের সহায়তা করেন, যাতে যতটুকু মুকুল এসেছে তা ধরে রাখা যায়।’
লিচু শিল্পের ভবিষ্যৎ কী?
লিচুর মুকুল না আসার কারণে এবারের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে, যা শুধু চাষিদের নয়, পুরো এলাকার অর্থনীতিতেই প্রভাব ফেলবে। লিচু চাষের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের জীবন-জীবিকায় বড় ধাক্কা আসতে পারে।
আলুর ফলন ভালো হলেও কৃষকের মুখে হাসির বদলে আহাজারি
চাষিরা বলছেন, এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কীভাবে লিচুর উৎপাদন বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যতে ঈশ্বরদীর লিচু চাষ সংকটের মুখে পড়তে পারে।
সোর্স: জুম বাংলা