মানসিকভাবে বিপর্যস্ত গাজার শিশু বলছে, ‘মা, আমি ক্লান্ত- মরতে চাই’
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত গাজার শিশু বলছে, ‘মা, আমি ক্লান্ত- মরতে চাই’
ফিলিস্তিনের যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজার বাসিন্দা সামা তুবাইল। তার সঙ্গে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কথা হয় যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর। যখন সামার সঙ্গে সিএনএন-এর সাক্ষাৎ হয় সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মা ওম-মোহাম্মদকে প্রশ্ন করে, “মা, আমি ক্লান্ত- আমি মরে যেতে চাই। আমার চুল কেন গজাচ্ছে না? আমি মরে যেতে চাই এবং জান্নাতে গিয়ে চুল ফিরে পেতে চাই, ইনশাআল্লাহ।”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ হাতে চুল আঁচড়ানোর ভঙ্গি করে, তারপরই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে আট বছরের সামা। সে বলে, “আমি খুবই দুঃখিত, কারণ আমার ব্রাশ দিয়ে আঁচড়ানোর মতো একটা চুলও নেই। আমি আমার সামনে আয়না ধরি, কারণ আমি চুল আঁচড়াতে চাই। আমি সত্যিই আবার চুল আঁচড়াতে চাই।”
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে তার লম্বা চুল ছিল। গাজার জাবালিয়ায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলত। কিন্তু সেই জীবন এখন শুধু স্মৃতি। ৭ অক্টোবরের পর তার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের কারণে ১৯ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির মতো সামা ও তার পরিবার নিজেদের ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পরিবারের সঙ্গে ঘরছাড়া হয়ে প্রথমে তারা দক্ষিণ গাজার রাফাহে আশ্রয় নেন। তারপর যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে কেন্দ্রীয় গাজার খান ইউনিসের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন তারা।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ গত জুনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজার প্রায় ১২ লাখ শিশুই বর্তমানে মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তায় ভুগছে, বিশেষ করে যারা একাধিকবার ভয়াবহ সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে।
গত জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, “একটি প্রজন্ম ভয়াবহ মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “শিশুরা নিহত হয়েছে, অনাহারে থেকেছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কষ্ট পেয়েছে। এমনকি অনেকে জন্মের আগেই মারা গেছে-মায়ের সঙ্গে প্রসবকালীন মৃত্যু হয়েছে।”
এর মধ্যেই মঙ্গলবার ইসরায়েল নতুন করে বিমান হামলা শুরু করলে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায়। এতে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয় বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীই শিশু দাবি করে এক চিকিৎসক সিএনএনকে বলেন, “আমি এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি।”
এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত পরিবার ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সিএনএনের সাক্ষাৎকার যুদ্ধবিরতি ভাঙার আগেই নেওয়া হয়েছিল।
গত বছর চিকিৎসকেরা সামার চুল পড়ার কারণ হিসেবে “নার্ভাস শক”-কে দায়ী করেন। বিশেষ করে, ২০২৩ সালের আগস্টে রাফাহতে তার প্রতিবেশীর বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর এ সমস্যা দেখা দেয়। অ্যালোপেসিয়ার (চুল পড়ে যাওয়ার একটি অবস্থা) বড় কারণ হিসেবে ৭ অক্টোবরের পর থেকে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন চিকিৎসকরা।
ঝুঁকির মধ্যে থাকা শিশুদের পাঁচশো’র বেশি অভিভাবকের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে, ৯৬% শিশু মনে করে তারা যেকোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারে, আর প্রায় অর্ধেক, ৪৯% শিশু ইসরায়েলের হামলার কারণে “মৃত্যুর ইচ্ছা” প্রকাশ করেছে।
সামার জন্য মানসিক যন্ত্রণা আরও গভীর হয় যখন চুল হারানোর কারণে অন্য শিশুরা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতে শুরু করে। লজ্জায় সে ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। বাইরে গেলে সবসময় একটি গোলাপি কাপড় পেঁচিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হয় তাকে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিএনএন তাদের আবার দেখতে গেলে সামা জানায়, “আমাদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে আমার কত স্মৃতি ছিল- আমার ছবি, সার্টিফিকেট, পোশাক, কত কিছু! কিন্তু আমি এখনো সেটা দেখতে পারিনি। যাতায়াতের খরচ অনেক বেশি। আর গেলেও সেখানে পানি নেই, আমরা কোথায় থাকব তাও জানি না।”
সূত্র: dailycomillanews