বাংলাদেশ

যুবলীগ নেতার সাত ফুট বাই আট ফুট ৭ ঘর, কী হতো এখানে?

রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের পানিশাইল (নিজগাঁও) এলাকায় জানালাবিহীন প্রায় ৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের সাতটি ঘরের সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ-এগুলো কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুর রকিব মন্টুর ‘টর্চার সেল’। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে কালো রঙের গাড়িতে করে তিনি লোকজন নিয়ে গভীর রাতে এখানে আসতেন, আবার ভোরে চলে যেতেন। এই ঘরগুলো নিয়ে স্থানীয়দের রহস্য এখনও কাটেনি।

সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নিজামপুর গ্রামের বাসিন্দা মন্টু সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ও বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একসময় তিনি মৌলভীবাজারের রাজনগরের পানিশাইল (নিজগাঁও) গ্রামে নিজের ও দখল করা জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছের বাগান গড়ে তোলেন। সেখানে নিজের জমি ২ একর ৭ শতাংশ। আর অন্যদের ২ একর ৪৭ শতাংশ জমি দখল করেছেন। অভিযোগ-সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল থাকাকালে মন্টু তার মামা পাশের জমির মালিক নুরুল ইসলাম কলা মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামার বসতবাড়িসহ পাশের সব জমি কেড়ে নিতে কেয়ারটেকারকে দিয়ে তিনি একের পর এক মামলা দিয়েছেন।

স্থানীয়দের দাবি, ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর রাতের আঁধারে নিজগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিকের পাশে মন্টুর সম্পত্তির কেয়ারটেকার আবদুল মালেককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই রাতে পুলিশ কলা মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মন্টু বাদী হয়ে রাজনগর থানায় ওই পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। একই মামলায় কলা মিয়ার নাতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজিজুর রহমান প্রান্তকেও গ্রেফতার করা হয়। কলা মিয়ার পরিবারের সদস্যরা কারাগারে থাকায় বসতঘরসহ সব জমি দখলে নেন মন্টু। মামা দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় তার জমি দখল করে মন্টু সেখানে ‘টর্চার সেল’ তৈরি করেন। কলা মিয়ার বসতঘরসহ নিজের জমির সামনের দিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ‘বশির-রাবেয়া কটেজ’ নির্মাণ করেন। প্রাচীরের ভেতরে একচালা টিনের আধাপাকা সাতটি আলাদা ঘর। এসব ঘরের কোনো জানালা নেই।

স্থানীয়রা জানান, দিনে এসব ঘর কখনো খুলতে দেখা যায়নি। তবে গভীর রাতে মন্টু লোকজন নিয়ে কালো রঙের গাড়িতে করে এখানে আসতেন, আবার ভোরের দিকে বেরিয়ে যেতেন। স্থানীয়রা তাকে এতটাই ভয় পেতেন যে প্রাচীরের ভেতরে যাওয়ার সাহস তারা করতেন না। এদিকে প্রায় আড়াই বছর পর এ বছরের জুনে কলা মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা জামিনে বের হন। এরপর তারা দেখেন বসতঘরসহ প্রায় ৪০ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছেন মন্টু।

পানিশাইল গ্রামের নান্নু মিয়া বলেন, আমরা ছোট থেকে দেখে আসছি কলা মিয়া এ বাড়িতে বসবাস করছেন। কলা মিয়া জেলে থাকায় মন্টু তার বাড়ি ও জমিজমা দখল করে সাতটি ছোট ঘর বানিয়েছেন। রাতে এসব ঘরে মন্টু ও তার লোকজন আসত। এসব ঘর আওয়ামী লীগের ‘টর্চার সেল’ আয়নাঘরের মতো ব্যবহার করা হতো। দীর্ঘদিন ধরে পরিবারটিকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন অ্যাডভোকেট মন্টু।

কলা মিয়া জানান, ৭০ বছর ধরে এ বাড়িতে থাকছি। আমার বোন ও বোনের ছেলেরা আমাকে স্থায়ীভাবে থাকতে এসব জমি আমার কাছে বিক্রি করেছেন এবং লিখে দিয়েছেন। কাগজপত্র থাকার পরও জমি কেড়ে নিতে বারবার মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করেছে মন্টু। নিজেই তার কেয়ারটেকারকে হত্যা করিয়ে মন্টু আমার পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছে। জামিনে এসে নিজের ভিটায় প্রবেশ করতে পারছি না। পুলিশকে দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।

কলা মিয়ার নাতি আজিজুর রহমান প্রান্ত বলেন, মন্টুর করা মামলায় দীর্ঘদিন জেলে থাকায় আমার ছাত্রত্ব বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছেন মন্টু। ৮৩ বছরের বৃদ্ধ অন্যত্র ভাড়া থেকেছেন। গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় আমরা বাড়িতে উঠেছি। কিন্তু পুলিশ নানাকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করছে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে অ্যাডভোকেট আবদুর রকিব মন্টুর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে রাজনগর থানার ওসি শাহ মো. মুবাশ্বির বলেন, জমি নিয়ে দুই পক্ষের দুটি মামলা রয়েছে। বৃদ্ধের ঘরে প্রবেশ করা নিয়ে একজন অভিযোগ করেছেন। তবে বৃদ্ধের পরিবারকে ঘরে থাকতে বাধা দেওয়া হবে না। টর্চার সেল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমি শুনেছি। বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button