আবরার ফাহাদকে নিয়ে যে লেখা পড়ে আপনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারবেন না
১ বছর আগে নানা চাপে আর নিষেধে ওকে নিয়ে লেখার সুযোগ হয়নি।একটা বছর পার হয়ে গেছে।সব থিতায়ে গেছে।কষ্ট,যন্ত্রণা,ক্রোধ সব।তবে স্মৃতিরা থিতায় না।দিনকে দিন আরো সূক্ষ্মভাবে মিশে যায় জীবনের দ্রবণে।
ওর সাথে আমার সম্পর্কটা আগে বলি,ওর আর আমার গ্রামের বাড়ি একই জায়গায়।ওর দাদা আর আমার দাদা ছিলেন ক্লাসমেট।তাঁরা ছিলেন আমাদের গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশ।একপুরুষ পরে ক্লাসমেট হয়েছিলাম আমি আর আবরার।অদ্ভুত ব্যাপার হল একই স্কুলে পড়লেও ওকে আমি চিনি নটরডেম কলেজে পড়তে এসে।পাশাপাশি রুমে থাকতাম আমরা।প্রচন্ড রুটিনড,রিলিজিয়াস & হেল্পফুল একজন মানুষ ছিলো ও।নটরডেমে পড়তে গিয়ে সবার মধ্যেই অল্পবিস্তর হতাশা আসে।ওর মধ্যে এই বিষয়টা তেমন একটা দেখিনি।কুষ্টিয়া থেকে নটরডেমে সবচেয়ে ভালো রেজাল্টাকারীদের মধ্যে ছিলো ও একজন।আর একটু স্পষ্টভাষী।কে জানতো স্পষ্টভাষা তার কণ্ঠকে আজীবনের জন্য রুদ্ধ করে দেবে!
আগের রাতে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রুমে এসে ঘুমাইছি।হঠাৎ সাড়ে পাঁচটায় আব্বুর কল।সারাদিন টিউশনি আর আব্বুর অপারেশনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছি।আমার আবার কল না ধরার বদঅভ্যেস আছে।একবার ভাবলাম ধরবো না।পরে কি ভেবে কলটা ধরলাম,সালাম দিলাম।ইয়ারপিসে আব্বুর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেলো,”মাশুক,একটা খারাপ খবর।রাব্বিকে(আবরারকে) নাকি মেরে ফেলেছে।বরকত (আবরারের বাবা) আমাকে কল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল।বাবা তুমি একটু শিওর হও তো।”
আধোঘুমে মনে হল ভুল শুনছি।আবার বললাম,”কোন রাব্বি?”আব্বু বলল,”বুয়েটের। “আমি বললাম রাব্বি কেন মরবে?ওকে কে মারবে?” আমার কোনমতেই বিশ্বাস হল না,তবুও বললাম আচ্ছা মনে ভয় ভুল খবর।তবে আমি দেখছি।”দ্রুত ফেসবুকে ঢুকলাম।আমার আইডিতে বুয়েটের অনেকেই অ্যাড আছে।কিন্তু তখন শেষ রাত্রি।মাত্র কজন অ্যাক্টিভ ছিলো।তবে নিউজফিড রিফ্রেশ করতেই একটা পোস্টে চোখ আটকে গেলো।
“আমাদের ১৭ ব্যাচের EEE dept এর আবরার ফাহাদ,প্রাক্তন নটরডেমিয়ান(শের এ বাংলা হল,বুয়েট) (১৭০৬০৯৮) আর নেই।
গতকাল (০৬-১০-১৭) রাত ৭-৮ টায় তাকে রুম থেকে শেরে বাংলা হলের কয়েকজন ডেকে নিয়ে যায়। এর মাঝে ওকে আর রাত দুটার আগ পর্যন্ত কোথাও দেখা যায় নাই। কজন আনুমানিক রাত দুইটায় হল এর সিড়ির কাছে ওর লাশ পরে থাকতে দেখে। ওর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।
ছেলেটি রাত ৭-৮ টায় সুস্থ অবস্থায় রুম থেকে গিয়ে রাত ২ টায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো যেটা মোটেই স্বাভাবিক না।
এর মাঝে কি এমন হলো ওটাই আমরা জানতে চাই”
বিশ্বাস হল না,আরো স্ক্রল করলাম।আরেকটা পোস্ট, সেইম পোস্ট, আরেকটা,আরো একটা!বুঝে গেলাম আবরার আর পৃথিবীতে নেই।দ্রুত আব্বুকে কল দিয়ে কনফার্ম করলাম।উনি শুনলেন,বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন;”সাবধানে থাকো,উল্টাপাল্টা কিছু কইরো না” বলে কলটা কেটে দিলেন।আবরারকে মেরে ফেলা হয়েছে।হঠাৎ ধাক্কা সামলে আমার পুরো শরীরে তখন আগুন জ্বলছে।বুয়েটের একজনের সাথে কথা হল।ও জানালো রাত দুইটার দিকে সম্ভবত মারা গেছে।পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।মেরেছে বুয়েটের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিছু শুয়োর।ও একজ্যাক্টলি এই শব্দটাই ইউজ করেছিলো;”শুয়োর”।একটা তাগড়া সুস্থ ছেলেকে শুধু স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল।শুয়োর কি এতটা নির্দয় হতে পারে কখনো?মনে হয় না।
ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে।সকালে আটটার দিকে আমার ঢাবির এক বন্ধুকে নিয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দী হলে।গিয়ে দেখি গেট বন্ধ করে রেখেছে। ভেতরে স্টুডেন্টদের ভিড়।সবাই হল প্রোভোস্টের রুমের সামনে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে।রায়ট পুলিশ গিজগিজ করছে ।কিছুক্ষণ পর বুয়েটের ২ জন টিচার আসলেন।গেট খুলে দিলো।আমি হলে ঢুকে পড়লাম।গিয়ে দেখি আমার বন্ধুরা সব ভয়ার্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আসে।
আচ্ছা আগে তখনকার বুয়েটের অবস্থাটা বলি..বুয়েটে তখন পুরো জঘন্য অবস্থা চলছিলো।ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররা র্যাগিং টর্চার এগুলোকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো।মাঝে মাঝেই শোনা যেতো বুয়েটের এক ছাত্রকে মেরে পা ভেঙে দিয়েছে,আবার শুনতাম থাপ্পড় দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছে।কিন্তু কিচ্ছু বাইরে আসতো না।এগুলো নিয়ে টু শব্দ করারও কারো সাহস ছিলো না।কেউ বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করলে তার শরীরেও রড স্ট্যাম্প দিয়ে চলতো বিভীষিকাময় নির্যাতন। শুধুমাত্র কিছু মেয়ে যারা হলে থাকেনা তাদের এগুলোর বিরুদ্ধে বলতে দেখতাম।তবে পরে তারাও চুপ হয়ে যেতো হয়ত সিনিয়রদের চাপে বা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় আর চোখ রাঙানিতে।অবস্থা তখন এমন দাঁড়িয়েছিলো যে যদি বিষয়টা প্রচার না পেতো,যদি গণমানুষ ফুঁসে না উঠতো তাহলে বুয়েটের যারা সেদিন সকালে হল প্রোভোস্টের দরজার সামনে বিচারের দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাদের প্রত্যেকের কপালে নির্যাতনের খড়গ নেমে আসতো। সকালে যখন পৌছাই তখনও খুনিরা বুক উঁচায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর খেয়াল করছিলো কে কে এসেছে,তাদের কিভাবে তাদের টাইট করা যায়।ওরা কোনভাবেই আশা করেনি যে যে এটা তারা ধামাচাপা দিতে ব্যর্থ হবে।তবে খুনের মোড় ঘুরানোর জন্য তারা অনেক কিছুরই চেষ্টা করেছিলো।তো যাই হোক,দেখলাম সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে তুমুল বাকবিতন্ডা চলছে।হল প্রভোস্ট আর পুলিশ বলছে দরজা বন্ধ করে আমরা ফুটেজ দেখবো,ছাত্ররা দবি জানাচ্ছে ফুটেজের একটা কপি তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। অফিসরুমের দরজাবন্ধের তীব্র চেষ্টা চলছে।এর মধ্যে একজনকে দেখলাম দরজার ক্রস করে শুয়ে পড়তে।এদিকে বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানলাম লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে আমার মেডিকেলের মর্গে।সময় নষ্ট না করে কলেজে চলে গেলাম।এরই মধ্যে নিষেধ সত্ত্বেও আমার আব্বু চলে আসলেন।২ দিন পর উনার পিত্তথালির পাথরের অপারেশন,আমারই মেডিকেলে।সারাদিন নানা রকম টেস্ট আর ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে দিন কাটছিলো আমার।তখনই ঘটলো ঘটনাটা।
মর্গের সামনে তখন খুব কম মানুষ।কজন চালাক সাংবাদিক,আমি-বাবা আর আমার কিছু বন্ধু। গিয়ে শুনি লাশ ইমার্জেন্সি মর্গে।কিছুক্ষণ পর আনবে।দাঁড়িয়ে থাকলাম,বৃষ্টি শুরু হল।ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে মর্গে যাতায়াতের সম্পূর্ণ সুযোগ আমার ছিলো।২ টা লাশ আসলো,সাদা কাপড় উল্টিয়ে দেখলাম,নাহ আবরার না।তৃতীয় লাশটার কাপড় উল্টিয়ে সেই চিরপরিচিত চেহারা চোখে পড়লো।আধবোঁজা চোখ,কেমন সাদাটে চামড়া,রক্ত কেটে গেছে।কপালে একটা ক্ষত,সম্ভবত রড বা স্ট্যাম্পের খোঁচায় হয়েছে।বেশিক্ষণ দেখতে দিলো না,ছবি তুলতে দিলো না।মর্গে নিয়ে গেলো।ফেসবুকের কল্যানে তখন মাত্র দেশের মানুষ জানতে শুরু করেছে ঘটনাটা।
আমি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে আইডি শো করে মর্গে ঢুকলাম।মর্গের বড় রুমটার বাঁপাশে ওর লাশ রাখা ছিলো।আমার লক্ষ্য ছিলো যেভাবেই হোক ওর শরীরে আঘাতের চিহ্নের প্রমাণ রাখা,যেহেতু প্রমাণ নেই।দ্রুত পরিস্থিতি বুঝে ২ জন সাংবাদিক ডেকে আনলাম,তারপর উপর থেকে কাপড় সরিয়ে ওর পা বাহু থাই সামনে সবদিক দিয়ে ছবি তুললাম।তবে উল্টে পিঠের ছবি তোলার আগেই আমাদের বের করে দেয়া হল।পরবর্তীতে ওই ছবিগুলোই ফেসবুকে ভাইরাল হয়।কয়েকটা পিছের দিকের ছবি ভাইরাল হয়েছিল কিন্তু ওগুলো আবরারের ছিলো না।আমরা উল্টিয়ে পেছনের ছবি তোলার সুযোগ পাইনি।ওর শরীর রক্তশূণ্যতায় পুরো সাদাটে হয়ে গিয়েছিলো।শুধু মারের জায়গাগুলোতে রক্তবাহিকা ফেটে চামড়ার নিচে রক্ত জমে কালচে হয়েছিলো।তলপেটে কালসিটে পড়ে ছিলো।পুরো বাহু আর পা জুড়ে মনে হল কালচে যন্ত্রণা জমে আছে।আমি বেশ শক্ত মনের মানুষ। কিন্তু ওর লাশটা দেখেই আমার মনটা হুহু করে উঠলো।
কি পরিমাণ মারলে একজন মানুষের শরীরের এমন অবস্থা হয়!কি প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে মৃত্যুর আগে।আমার আব্বু লাশ দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।দুইদিন পর উনার অপারেশন।সাংবাদিকদের ছবিগুলো প্রকাশের অনুরোধ করে আমি আব্বুকে নিয়ে আমার আপুর বাড়ি চলে আসলাম।
বিকালে শুনলাম লাশ কুষ্টিয়া গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবে।আমার দুই বন্ধুকে নিয়ে ওই রাতেই ট্রেনে চড়ে বসলাম।কুষ্টিয়া পৌছালাম সাড়ে সাতটার দিকে।ওখান থেকে গড়াই পার হয়ে রায়ডাঙা পৌছালাম আটটায়।গিয়ে দেখি লাশবাহী ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স দাড়িয়ে আছে।চারপাশে পুলিস সাংবাদিকে ভর্তি।ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সের ঝাপসা কাঁচ দিয়ে সাদা কাপড়ে জড়ানো ওর দেহটা শেষবারের মত দেখতে লাইন দিয়েছে শতশত মানুষ।আমিও লাইনে দাঁড়ালাম।দেখলাম,শেষ দেখা।দেখার কিছু ছিলো না আর। পোস্টমর্টেম করা একটা বড়ি,সাদা কাফনে ঢাকা।শুধু মুখটা বের হয়ে আছে।চোখদুটো বন্ধ,কালো হয়ে আছে পাতার চারপাশটা।ধবধবে সাদা সেই চেহারায় আমার পরিচিত সেই জীবন্ত লাল আভাটা আর নেই।অদ্ভুত একটা মুখ,আর কোন কষ্ট নেই,চাওয়া-পাওয়া নেই,রসিকতা বিদ্রুপ কিচ্ছু নেই।স্রেফ প্রাণহীন একটা শরীর।পিছের জনের ধাক্কায় সরে আসলাম শেষবারের মত দেখে।কিছুক্ষণপর জানাজা হল।প্রচন্ড সম্ভাবনাময় এবং আমার পরিচিত সবচেয়ে ধার্মিক,গোছানো স্পষ্টভাষী ছেলেটা মাত্র ১ দিনের ব্যবধানে পৃথিবীর মাটির উপরে বেড়ানো একজন মানুষ থেকে মরহুম হয়ে গেলো।দাফন শেষে পদ্মার ধারে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। ফিরে এসে ওর বাড়িতে গেলাম আন্টি-আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে।
একটা ঘরে চারপাশে মানুষের ভীড়।একটা বিছানার ওপর শুয়ে ফাহাদের আম্মু জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন।কষ্ট যন্ত্রণা সীমাহীন হলে মানুষের মধ্যে যেমন একটা নিস্তেজতা চলে আসে উনিও তেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছেন।মাঝে মাঝে হঠাৎ করে দমকা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।আমি গিয়ে উনাকে ডাকলাম।উনি আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখলেন।অনুভূতিশূন্য ফাঁকা দৃষ্টি।আমি খাটে বসলাম।চেনার সাথে সাথে আমার বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।আমার মাথা কাজ করছিলো না।আমি বুঝতে পারছিলাম না কি বললে বা কি করলে উনার দুঃখটা একটু হলেও কমানো সম্ভব। নাহ আর সেটা সম্ভব না।
কিছুক্ষণ কেঁদে উনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।ফাহাদের ক্লাসমেট, বন্ধু ভাই।আমার হাত চেপে ধরে আন্টি বারবার বললেন,”দেখো বাবা আমার ছেলেটা চলে গেলো।আর আসবে না।নামাজ পড়তে মসজিদে যেতো,প্রতিবার আজানের সময় আমার ওকে মনে পড়বে।আল্লাহ পৃথিবীর কোন মা কে যেন এ কষ্ট না দেন।আর বাবা তুমি ফেসবুকে কখনো কাউকে নিয়ে কিছু লিখবা না।এই দেখো আমার ফাহাদটা চলে গেলো…আবার উনি হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।আমি উনার আমার চোখ মুছে উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।মূলত এ ঘটনার পর থেকেই আমি ফেসবুকে সমালোচনামূলক লেখা বাদ দিয়ে ফানি & সার্কাস্টিক লেখা শুরু করি।
শুনলাম ফাহাদ মারা যাওয়ার পর থেকে উনি কিছু খাননি।একজন খাবার নিয়ে বসে আছে।আন্টি খাচ্ছেন না।আমি আন্টিকে হাত ধরে প্রবোধ দিলাম।উনি একগাল মুখে নিলেন।আমি চলে আসলাম।হঠাৎ উনি পেছন থেকে ডাকলেন,”বাবা তুমি খেয়েছো?”মা আসলে মা ই হয়।এত কষ্টের ভেতরেও উনি স্নেহমমতা ভোলেন নি।উনার মত এত স্ট্রং মা আমি কখনো দেখিনি।আমি কোনমতে কান্না আটকানো গলায় “জ্বী খেয়েছি” বলে বের হয়ে আসলাম।
সেদিনই বিকেলে কুষ্টিয়া ফিরে আসলাম।ইচ্ছে ছিলো সবাই মিলে খুনিদের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে একটা মানববন্ধন করবো।রাতে জুনিয়র ব্যাচ প্রতিনিধিদের সাথে কথা বললাম,যেমনেই হোক আমরা প্রতিবাদ করবো।কিন্তু রাজনৈতিক চাপে এবং নিরাপত্তার অজুহাতে পুলিশ আমাদের মানববন্ধনের অনুমতি দিলো না।স্রেফ জানিয়ে দিলো মানববন্ধনে হামলা হলে দায় পুলিশের নয়।পরদিনই কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের মসজিদে ছাত্রলীগ আয়োজিত দোয়ামহফিল এবং আবরারের আত্নার মাগফেরাত কামনা অনুষ্ঠিত হল।জীবন্ত আবরারকে আত্না বানায়ে সেই আত্নার মাগফেরাত কামনা..বাহ,হাস্যকর পরিবেশ।কুষ্টিয়ায় তখন চরম লেভেলে হিপোক্রেসি চলছে।তবে পরদিন সকালেই আব্বুর অপারেশনের প্রস্তুতির জন্য আমি ঢাকা ব্যাক করি।তাই আর কিছু দেখতে হয়নি আমাকে।
আবরারের মৃত্যু পুরো দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে।আমরা ওর বন্ধু।আমাদের যন্ত্রণাটা বলে বোঝানো যাবে না।মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধী লাগে যে ওর জন্য কিছু করতে পারিনি,বাঁচাতে পারিনি ওকে।আবরারের বাবা মার সামনে লজ্জায় দাঁড়াতে পারিনা।মনে হয় আবরারের সাথে সাথে আমারও একটা অংশকে কবর দিয়ে এসেছি।দিনকাল এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।এখনো রাতে বের হই,আড্ডা চলে।নানা রকম হিউমার আর জোকসে হো হো করে হাসি।হঠাৎ একজন বলে,কাল রাতে আবরারের কথা খুব মনে পড়ছিলো রে।সবাই চুপ হয়ে যায়।কেমন বিষন্নতা গ্রাস করে পরিবেশে।দিন পেরিয়ে যায়,কিন্তু স্মৃতির আঁচ পাওয়া সেই বিষন্নতা দিনকে দিন শুধু গাঢ়ই হতে থাকে।আবরার হত্যাকারীদের বিচার চাই,যদিও আমি এখনো পুরো আশাবাদী নই।ওকে ফেরত পাওয়া যাবে না,ওর হাসিমাখা মুখ থেকে অস্থির গলায় “কি অবস্থা মাশুক” আর শোনা হবে না।তাই স্রষ্টার কাছে শুধু এইটুকু প্রার্থনা..যতটা যন্ত্রণায় সে পৃথিবী ছেড়েছে,সুদে-আসলে তার চেয়ে বেশি চিরকালীন শান্তিতে তার পরকালীন জীবন তুমি পরিপূর্ণ করে দিও…আমিন।
মুকতাদির হাসান মাশুকOctober 6, 2020