সংবিধান বাতিল না করলে ফাঁসবেন বর্তমান সরকারের সবাই!
গত ১৫ বছরে পতিত স্বৈরশাসক নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ও চূড়ান্ত কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠতে সংবিধানকে কাঁটাছিড়া করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল যে একজন নাগরিক চাইলেও সংবিধানটি সঠিকভাবে অনুসরণ করে চলতে পারবেন না সেটা না ভেঙে (one cannot follow the constitution properly without breaking it)। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও দায়িত্ব নিয়ে পড়েছেন বেশ ঝামেলায়। রয়েছে প্রশ্নও। তারাও দৃশ্যত: সংবিধানের কিছু অংশ মানছেন বা মানতে পারছেন আবার অন্য অংশ কিংবা বহু অংশ মানছেন না বা মানতে পারছেন না।
সংবিধান যে কী অবস্থায় আছে তা কয়েকটি উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে।
প্রথমত: ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করা যাবে যা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল ও নজীরবিহীন এবং এক সাথে ৩০০+৩০০ মোট ৬০০ এমপি স্বল্পসময়ের জন্য হলেও নির্বাচিত থাকেন একসাথে! এই বিধানের প্র্যাকটিস পতিত সরকার করেছেনও।
দ্বিতীয়ত: ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, রদ, ষড়যন্ত্র ও সর্বোচ্চ শাস্তির কথা এমনভাবে লিখে সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে পতিত সরকার বা তাদের কোনো দোসর যদি কোনোভাবে ক্ষমতায় আসতে পারে তাহলে বর্তমান সরকারের সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে।
তৃতীয়ত: ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু স্পিকার যদি অসমর্থ বা অনুপস্থিত হন তাহলে কে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন এই বিষয়টি সংবিধান অনুধাবন (contemplate) করেনি।
চতুর্থত: ৪৭ অনুচ্ছেদে অনেক বিধান আছে যা সরাসরি মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদের সরাসরি বিপরীত ও সাংঘর্ষিক।
পঞ্চমত: সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সিংহভাগ সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের contradiction and inconsistency-এর ব্যাপারে আরো বহু উদাহরণ দেয়া যাবে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শতাব্দির সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ট গণ-অভ্যূত্থান থেকে জন্ম নেয়া বর্তমান সরকারকে সংবিধান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। সংবিধান নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে তিনটি অপশন খোলা। চলুন দেখি এবার অপশনগুলো কী কী।
প্রথম অপশন: গত ১৫ বছরে কাঁটাছেড়া করা সংবিধান ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ আসনে MCA (Member of Constituent Assembly) নির্বাচিত করে Constituent Assembly গঠন করা। এটির একমাত্র ও কেবলমাত্র কাজ হবে সংবিধান রচনা ও গৃহিত (adopt) করা।
বিজ্ঞাপন
এর সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য এক সাথে গণভোটের আয়োজনও করা যেতে পারে।
আমাদের সংবিধানের শুরু ও যাত্রা ছিল গলদপূর্ণ। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে adopt করার জন্য ১৯৭০ সালের পাকিস্তান আমলের Legal Framework Order (LFO) এর অধীনে নির্বাচিত এমপি দ্বারা গঠন করা হয় Constituent Assembly। এখন প্রশ্ন হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে খোদ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া দেশের সংবিধান রচনা ও অনুমোদন সেই পাকিস্তানের সংবিধান ও LFO অধীনে নির্বাচিত এমপিরা করেন কিভাবে? এই যৌক্তিক প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশের সাবেক মেধাবী প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢাকার এক সেমিনারে।
দ্বিতীয় অপশন:
৫০/৬০ জন বিশেষজ্ঞ (সংখ্যা কমবেশি হতে পারে) নিয়ে সংবিধান প্রনয়ন কমিটি গঠন করা যাদের একমাত্র দায়িত্ব হবে নতুন একটি সংবিধান ড্রাফট করা। এই নতুন সংবিধান সুষ্ঠু, অবাধ ও সত্যিকার অংশগ্রহণমূলক (participatory) গণভোটের মাধ্যমে গৃহিত হবে। একই সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য গণভোটের আয়োজনও করা যেতে পারে, যেভাবে বৃটেনে একদিনে একাধিক নির্বাচন হয়।
তৃতীয় অপশন:
১/১১ সরকারের মতো এই সরকার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপর নির্ভর করবে। অর্থাৎ ১/১১ সরকারের মতো যতদিন থাকবে থেকে যাবার পর পরবর্তী সরকার এসে তাদের মেয়াদ, চলমান কার্যাবলী ও সংবিধান পরিবর্তনের বৈধতা দিবে।
প্রথম অপশন বা দ্বিতীয় অপশনে যাওয়া হবে উত্তম। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর সফল গণ-অভূত্থানের মাধ্যমে আসা জাতির জন্য এমন সুযোগ আর নাও আসতে পারে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতিকে নতুন একটি সংবিধান উপহার দেয়া সময়ের দাবি। নতুন সংবিধান রচনা করা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক সরকার তাদের স্বার্থ ছাড়া সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনে হাত দিবে না।
অপরদিকে অনেক সময় রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও আমলাদের প্রচণ্ড চাপে সরকার সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জিতে সরকার গঠন করেন। ঐ সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের অধীনে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করতে চাইছিলেন। ঠিক ঐ সময় বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া আমলাদের চাপে ও তদবিরে তৎকালীন আইন উপদেষ্টা প্রতিথযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার ইসতিয়াক আহমদকে ফোন করে অনুরোধ করেন যেহেতু আমাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আছে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের বিষয়টি, এটা আমরা করবো। আমাদের জন্য রেখে দিন। বিপুল ভোটে নির্বাচিত চারদলীয় জোটের নেত্রী যিনি বিশাল মেন্ডেট নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন তাঁর প্রতি সম্মান রেখে তাদের জন্য রেখে দিয়েছিলেন আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার ইসতিয়াক আহমদ। ইতিহাস সাক্ষী আবার সেই আমলাদের চাপে ও তদবিরে বেগম জিয়ার সরকার বিচার বিভাগের আর পৃথকীকরণ করতে পারেন নি। বেশ ক’বছর আগে লন্ডনে এক সেমিনারে এ তথ্যটি প্রকাশ করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল।
তৃতীয় অপশনে গেলে তা হবে বিপজ্জনক ও তাতে ঝুঁকি বেশি। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মূখার্জির বই থেকে স্পষ্ট যে, ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন (controlled election)। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের নিরাপদ প্রস্তানের (safe exit) জন্য ও তাদের মেয়াদ ও চলমান কর্মের বৈধতার জন্য একটি দলের সাথে পর্দার আড়ালে গোপন আঁতাতের ফলে দুই-তৃতীয়াংশ আসন আনতেই হতো। দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে কি না এই নার্ভাস থেকে বেশি চাপ দেয়ায় বিএনপির আসন একেবারে ৩০ এর কোটায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার পাবলিকলি বলেছেন আরো একটু ম্যাকানিজম করলে বিএনপি বিরোধী দলের আসনেও বসারও যোগ্যতা হারাতো। অথচ বিএনপি ৩০ এর কোটার পরিমাণ আসন পাবার মতো দল ছিল না। ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল ম্যানেজড ইলেকশন তার আরেকটি প্রমাণ হলো ব্রিগেডিয়ার (অব:) বারীর সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। তিনি তার সাক্ষাৎকারে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন – ১/১১ এর বিভিষিকাময় দিনগুলোর ঐ সময় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত সাব-জেলে কিভাবে মেজর জেনারেল আমীন ও ড. গওহর রিজভী (সমঝোতার জন্য) নীরবে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করতেন! প্রণব মূখার্জির বই এবং ব্রিগেডিয়ার (অব:) বারীর সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকার হচ্ছে সমর্থনমূলক প্রমাণ (corroborative evidence)।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিৎ অবিলম্বে সংবিধান সম্পর্কে তারা কী করতে যাচ্ছেন তা জাতিকে বিস্তারিতভাবে জানানো। সফল গণ-অভ্যূত্থান থেকে মেন্ডেটপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান নিয়ে যা-ই করবেন জনগণ তাদেরকে overwhelming সাপোর্ট করবে। অযথা দেরি করা ঠিক নয়। দেরি করলে গণ-অভ্যূত্থান থেকে সৃষ্ট momentum আস্তে আস্তে হ্রাস পাবে। জাতি সংবিধান নিয়ে অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। এই ধোঁয়াশাই সৃষ্টি করে গুজব, কানকথা ও উৎকন্ঠা। যে যাই বলুক, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে মেরামত ও দেশকে অবারিত সম্ভাবনার পথে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের দরকার নতুন, যুগোপুযোগী আধুনিক ও গতিশীল সংবিধান।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।