প্রবাসমালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ায় সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির দ্বিতীয় নিবাস

ডেস্ক রিপোর্ট:
মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ায় বাংলাদেশিদের অবস্থান ওপরের দিকেই রয়েছে। মাই সেকেন্ড হোম (এমএম২এইচ) কর্মসূচির মাধ্যমে দেশটিতে দ্বিতীয় নিবাস গড়েছেন ৩ হাজার ৬০৪ বাংলাদেশি। সর্বশেষ তথ্যমতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, বিভিন্ন দেশের ৫৮ হাজার ৪৬৮ জন নাগরিক মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ৩ হাজার ৬০৪ বাংলাদেশি।

৯ মার্চ রবিবার, দেশটির পর্যটন, শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী দাতুক সেরি তিওং কিং সিন এক বিবৃতিতে বলেছেন মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএম২এইচ) প্রোগ্রামে বিশ্বের যেকোনো দেশের আবেদনকারীদের জন্য উন্মুক্ত।

তিনি বলেন এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে, বিদেশিরা বিভিন্ন যোগ্যতার মানদণ্ডের অধীনে বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারবেন এবং যারা সফল হবেন তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি বসবাসের পাস পাবেন।

এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যটন, শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী দাতুক সেরি তিয়ং কিং সিং সংসদে বলেছেন, মোট অনুমোদনের মধ্যে ৫৭ হাজার ৬৮৬টি অনুমোদন পূর্বের নীতির আওতায় প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৮ হাজার ২০৯ জন মূল আবেদনকারী এবং ২৯ হাজার ৪৭৭ জন ডিপেন্ডেন্ট রয়েছে। তবে কোন দেশের কতজন রয়েছে তা বলেননি তিনি।

গত বছরের ২৯ মার্চ, পর্যটন, শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আরেক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, দেশটিতে গত ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৬৬ জন এক্টিভ সেকেন্ড হোম পাস হোল্ডার রয়েছেন। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৭৬৫ জন পাসধারী নিয়ে শীর্ষে ছিলেন চীন। এরপরে যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়ার ৪ হাজার ৯৪০ জন, জাপানের ৪ হাজার ৭৩৩ জন এবং বাংলাদেশের ছিল ৩ হাজার ৬০৪ জন।

মন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন নীতির আওতায় এখন পর্যন্ত ৭৮২টি অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩১৯ জন মূল আবেদনকারী এবং ৪৬৩ জন ডিপেন্ডেন্ট রয়েছে। মন্ত্রী টিয়ং আরও জানান, নতুন শর্তাবলির অধীনে অনুমোদিত মাই সেকেন্ড হোম পাসধারীদের কাছ থেকে সরকার আনুমানিক ২৩৩.৮ মিলিয়ন রিঙ্গিত স্থায়ী আমানত এবং ২২২ মিলিয়ন রিঙ্গিত রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ এসেছে।

২০২৩ সালের জুন মাসে, মাই সেকেন্ড হোম কর্মসূচির জন্য সর্বশেষ নির্দেশিকা প্রকাশ করে, যেখানে তিনটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয় – সিলভার, গোল্ড, এবং প্লাটিনাম। এছাড়াও, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের জন্য একটি বিশেষ ক্যাটাগরি সংযোজন করা হয়। নতুন নীতির অধীনে, এই কর্মসূচি শুধুমাত্র মালয়েশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা দেশের নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং আবেদনকারীর ন্যূনতম বয়স হতে হবে ২৫ বছর এবং প্রতি বছর অন্তত ৯০ দিন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করতে হবে।

প্লাটিনাম ক্যাটাগরির জন্য ১০ লাখ মার্কিন ডলার, গোল্ড ক্যাটাগরির জন্য ৫ লাখ মার্কিন ডলার এবং সিলভার ক্যাটাগরির জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার স্থায়ী আমানত হিসেবে বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়া, আবেদনকারীদের মালয়েশিয়ায় ৬ লাখ রিঙ্গিত থেকে ২০ লাখ রিঙ্গিত মূল্যের সম্পত্তি কিনতে হবে, যা নির্ভর করবে তাদের বেছে নেওয়া ভিসা ক্যাটাগরির উপর।

জরিপ বলছে, গত ৭ বছরে বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৪ গুণ। দেশটিতে বাস করা বাংলাদেশি ও নানা মহলের কাছ থেকে জানা গেছে, সেকেন্ড হোম করতে যে টাকার প্রয়োজন হয়, তা বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি বলেন, মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোমের জন্য ব্যবসায়ীদের অনেক সুবিধা দেয়। কেউ দেশের ‘আনরেষ্ট’ থেকে বাঁচতে, আবার কেউ তার সম্পদ সরাতে সেকেন্ড হোমের আশ্রয় নিয়েছেন। ওখানে একজন বাংলাদেশি ব্যক্তি গড়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করলেই সেকেন্ড হোমের সুবিধা পান।

প্রবাসী বাংলাদেশি বলেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি এলাকা গড়ে উঠেছে। সেখানকার অধিবাসীরা ফ্ল্যাট কিনে থাকছেন। আর ফ্ল্যাটের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়েও কম। কেউ কেউ বাড়ি কিনেছেন, আবার কেউ কিনেছেন ফ্ল্যাট। মালয়েশিয়ার শিক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম বানানোর আরেকটি কারণ।

ঠিক কোন শ্রেণির লোক মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন সে ব্যাপারে কোনো গবেষণা নাই। তবে যারা এটা করছেন তারা সাধারণ লোক নন। তাদের অর্থ এবং ক্ষমতা আছে, তারা ব্যবসায়ী হতে পারেন। আর বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদই ব্যবসায়ী তারা কোনো ঝামেলা হলে সেটা সামলানোরও ক্ষমতা রাখেন।

মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোমের ব্যাপারে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করে না। বিনিয়োগের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করে না। বাংলাদেশে একটা ফ্ল্যাট কিনলে অর্থের উৎস জানাতে হয়। তাই বাংলাদেশে যাদের অবৈধ আয় আছে বা যারা অর্থের উৎস জানাতে অক্ষম, তারা মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন আর হুন্ডির মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার করছেন।

তবে কেউ কেউ আছেন যাঁরা বৈধভাবেও এটা করছেন। কিন্তু এতে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে যা দেশে বিনিয়োগ হতে পারত, তা বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে অবৈধ টাকাও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন। অনেকেই বলছেন, মালয়েশিয়া টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করায় বাংলাদেশিরা এই সুযোগ নিচ্ছেন।
এ দিকে মালয়েশিয়াতে কয়েক হাজার বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের ব্যবসা গড়েছেন। ওই দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পাঁচতারা হোটেল ব্যবসা, গার্মেন্ট কারখানা, ওষুধশিল্পসহ নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অনেকে রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ বড় বড় শপিংমলে দোকানও কিনেছেন। অনেকে স্বর্ণ, খেলনা, তৈরি পোশাকের ব্যবসা করছেন।

এদের কেউই বৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই তারা মালয়েশিয়াতে টাকা নিয়ে গেছেন। অনেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন কৃষি খাতসহ বিভিন্ন খাতে।

এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্সের সদস্য ডা. শংকর পোদ্দার বলেছেন, যারা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে যুক্ত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই নিজের নিরাপত্তা ও বিনিয়োগের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যুক্ত হয়েছেন।

ডা. শংকর বলেছেন, বাংলাদেশের সরকারকে এই বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। কেন নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস করতে যাচ্ছে মানুষ। আর মালয়েশিয়া আমাদের জন্য যা করতে পারছে, আমরা কেন তা পারছি না। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ কবে অন্য দেশের মানুষের সেকেন্ড হোম হবে, সেদিকে নজর দেয়া উচিত।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য এখন পর্যন্ত সামান্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের তথাকথিত সেকেন্ড হোম তৈরি করা, সিঙ্গাপুরের তারকা হোটেলের মালিকানা নেওয়া ও সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা এমন বিষয় অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। অভিযোগ আছে, দেশ থেকে পাচার করা অর্থ এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে বাংলাদেশিদের অবস্থান একসময় ছিল তৃতীয়; এবার ৪র্থ স্থানে নেমে এসেছে।

এর আগে সরকার নামমাত্র করের বিনিময়ে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনার সুযোগ দিয়েছিল। তবে সেই সুযোগ কেউ নেননি। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সরকারের উচিত আইনের প্রয়োগ বাড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার রোধ করা।

Source: প্রবাস বার্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button