সংবিধান বাতিল এবং ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করতে হবে
কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ফরহাদ মজহার দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা-উবিনীগ এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করছেন ‘চিন্তা’। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔধশাস্ত্রে স্নাতক এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’, ‘মোকাবিলা’, ‘এবাদতনামা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’, ‘ক্ষমতার বিকার’ ইত্যাদি। ফরহাদ মজহারের জন্ম ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীতে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন ও সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম
সমকাল: নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আপনি কবিতায় বলেছিলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান সহজ কর্ম নয়’। এবারের অভ্যুত্থান কতটা কঠিন ছিল?
ফরহাদ মজহার: এবারের গণঅভ্যুত্থানটি ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। ছাত্রনেতারা আন্দোলন ছাত্রদের হাত থেকে নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে তুলে দিয়েছিল। ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ আন্দোলনের ফল আওয়ামী লীগের কাছে, কেউ বিএনপির কাছে দিয়ে দিল। ফলে পরবর্তী সময়ে তিন দলীয় জোটের আবির্ভাব ঘটে। ওই সময় আমি বলেছিলাম, বাম দলগুলো বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অথচ এটি তাদের করার কথা ছিল না। ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা দ্বারা পুরোনো সাংবিধানিক কাঠামো বহাল রেখে তারা সংবিধানে কিছু পরিবর্তন এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করেছে। এরই মধ্য দিয়ে তারা পুরোনো রাষ্ট্র কাঠামো এবং রাষ্ট্রশক্তির ধরনটাই বহাল রেখেছিল। সেই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বদলানো আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক এক ব্যবস্থার প্রচলন হলো, যার ঘাড়ে চড়ে পরবর্তী সময়ে এক-এগারোতে সেনা-সমর্থিত সরকার এলো। তারা যাওয়ার সময় শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে চরম ফ্যাসিস্ট ও খুনি ব্যবস্থা কায়েম করল।
সমকাল: আমরা জানি, বাহাত্তরের সংবিধান নিয়েও আপনি একই ধরনের প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে তুলে আসছেন।
ফরহাদ মজহার: আমি মনে করি, বাংলাদেশের সংবিধানটি পাকিস্তানি ব্যবস্থারই ধারাবাহিকতা। কারণ আপনি যাদের ভোট দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সংবিধান বানাতে, তাদের মাধ্যমে গঠিত গণপরিষদই ওই সংবিধান প্রণয়ন করেছিল। একটি স্বাধীন দেশ গড়ার পর এটি কেন করা হলো? এ অধিকার তাদের কে দিয়েছিল? বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে বামপন্থিরা বেশ উৎসাহী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর জনগণকে তাদের দেশ গড়তে গঠনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার দেওয়া হয়নি। জনগণের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছিল।
সমকাল: সংবিধান নিয়ে তাহলে কী করতে হবে?
ফরহাদ মজহার: নতুন করে সংবিধান সভা করতে হবে। আমি অবশ্য ‘সংবিধান সভা’ বলি না। বলি, ‘গঠনতন্ত্র সভা’ (কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি)। এই যে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে ‘কনস্টিটিউট’ বা ‘গঠন’ করতে দেওয়া হলো না, এটাই বাংলাদেশের এই ‘অরিজিনাল সিন’ বা আদি পাপ। এই আদি পাপ থেকে বের হতে না পারলে আমরা কোথাও যেতে পারব না। জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী দেশে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সঙ্গে আপস করার কোনো জায়গা নেই। আমি বারবার বলে এসেছি, আবারও বলছি, এবারও গণঅভ্যুত্থানের পর পুরোনো ঘটনা ঘটছে। তবে আমরা তা প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। গণঅভ্যুত্থানের নেতারা এবং সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন গঠনতন্ত্র চায়। সেই দাবি উঠে গিয়েছে। আশা করি, এবার আমরা সফল হবো।
সমকাল: এবার কীভাবে পুরোনো ঘটনা ঘটছে?
ফরহাদ মজহার: আমাদের ছেলেমেয়েদের যে অর্জন, সেটা এসেছে লাশের ওপর দিয়ে। এত সংগ্রাম ও রক্তের ওপর দিয়ে যে অর্জন আমরা করেছি, সেটি শুরুতেই ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। একে বলা হয় সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব। ড. ইউনূস ও তাঁর কেবিনেটকে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে নিযুক্ত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নিয়ে পুরোনো সংবিধান বহাল রাখার চেষ্টা চলছে।
সমকাল: গণঅভ্যুত্থান এখনও শেষ হয়নি, নাকি গণঅভ্যুত্থান সফল হয়নি?
ফরহাদ মজহার: যদি প্রশ্ন করেন, গণঅভ্যুত্থান কি হয়েছে? আমার উত্তর হলো, জি, হয়েছে। অবশ্যই। যদি প্রশ্ন করেন, গণঅভ্যুত্থান কি ‘বিজয়ী হয়েছে? আমি বলব– না, হয়নি। এই প্রশ্নোত্তরের মধ্যেই আমরা চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংক্ষেপে বুঝতে পারব। আমরা বুঝতে পারব আমাদের এখন করণীয় কী। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও এই প্রেক্ষিতে করণীয় বুঝতে হলে আপনাদের এ কথা মনে রাখতে হবে যে, গণঅভ্যুত্থানের বিজয় আগের মতোই ছিনতাই করা হয়েছে। নব্বইয়ের সঙ্গে এবারের গণঅভ্যুত্থানের পার্থক্য এখানে। ছিনতাই হয়েছে ভিন্নভাবে।
সমকাল: এবার কীভাবে ছিনতাই হলো, ব্যাখ্যা করবেন?
ফরহাদ মজহার: এখনকার ছিনতাইয়ের রূপটা হলো, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে গণঅভ্যুত্থানকে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে। জনগণ সার্বভৌম। জনগণ সব সময়ই সংবিধান ও রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে। তাই জনগণ যখন এই সংবিধান ও রাষ্ট্র উৎখাত করে নতুন রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে চাইছে, ঠিক তখনই তাকে আবার পুরোনো ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের অধীনে বন্দি করে ফেলা হয়েছে। তাই এখন জনগণের রণধ্বনিটা হলো, হাসিনার রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ক্ষমতা আবার জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনা। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র উৎখাত করতে হবে, জনগণ নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। যেহেতু ড. মুহাম্মদ ইউনূস জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি। অতএব, জনগণের পক্ষে তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি। জনগণের অভিপ্রায়ই সার্বভৌম; সেই অভিপ্রায়ই রাষ্ট্র বানায়, গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে। তারই অভিব্যক্তি হলো মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জনগণের অভিপ্রায় দ্বারা ইতোমধ্যে নির্বাচিত। তাঁর আর আলাদা করে ‘নির্বাচিত’ হওয়ার কোনো দরকারই নেই। কিন্তু তিনি যখনই বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় ঢুকলেন, তিনি তখন শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীন। তখনই গণঅভ্যুত্থানের বিজয় ছিনতাই হয়ে গেল।
সমকাল: বিদ্যমান সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরে ক্ষমতার হস্তান্তর কীভাবে সম্ভব?
ফরহাদ মজহার: সংবিধান না থাকলে রাষ্ট্র থাকে না কিংবা সংবিধান না থাকলে আইনকানুন, কোর্ট-কাচারি থাকে না– এটা একেবারেই অর্থহীন ও ফালতু যুক্তি। আইনি বা রাজনৈতিক সাহিত্যে এটা বহুবারই নাকচ হয়েছে। বহু দেশ আছে, তাদের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। যেমন ইউনাইটেট কিংডম, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি। ইসরায়েলের তো কোনো সংবিধান নেই, তাহলে ইসরায়েল কীভাবে আছে? এই ফালতু যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ঢুকিয়ে দিলাম ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে। গণঅভ্যুত্থান ও জনগণের অভিপ্রায়কে আমরা আইনি তর্কে পরিণত করেছি। অথচ এটা তো রাজনৈতিক তর্ক এবং রাজনীতি ও আইনের সম্পর্ক বিচারের বিষয়। আমরা প্রতিবিপ্লবের ফাঁদে পা দিয়েছি।
সমকাল: তাহলে দেশ কীভাবে চলবে, আইনি কাঠামো তো লাগবে?
ফরহাদ মজহার: এই তর্কটা একেবারেই অর্থহীন। এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। সংবিধান মানে কী? লিখিত আইন, তাই তো? যেহেতু ড. মুহাম্মদ ইউনূস সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি, তাঁর নির্দেশই এখন আইন। কারণ তিনি জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় ধারণ করেন।
সমকাল: তিনি কি প্রতিদিন নির্দেশনা দেবেন?
ফরহাদ মজহার: না। তার দরকার নেই। মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দেবেন– আজ থেকে আমাদের সবকিছু প্রচলিত আইন, বিধান, নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদি দ্বারা চলবে। তবে কোনো আইন যদি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ হয়, সে আইন সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে যাবে; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন প্রয়োগ হবে। ব্যস। সিম্পল। এই এক লাইনই যথেষ্ট। এখন আইনের কী থাকবে আর কী থাকবে না, সেটা আদালত দেখবেন। এর মাধ্যমে তিনি জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ই ব্যক্ত করলেন। কী থাকবে, কী থাকবে না– নির্দেশ দিয়ে তিনি আমাদের আগামী গঠনতন্ত্রের রূপ কেমন হতে পারে তার আভাসও দিয়ে রাখলেন। ইতোমধ্যে আমাদের কাজ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের স্বীকৃত আইন, সনদ বা ঘোষণাকে আমরা আরও ক্রিয়েটিভভাবে কীভাবে আমাদের জন্য আরও উপযুক্ত করে নিতে পারি। ব্যস। আরও ভাবনা ও পর্যালোচনা, বিশেষত গঠনতন্ত্র প্রণয়নে জনগণকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, সেটাই এখন আমাদের আসল কাজ।
সমকাল: আপনি তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
ফরহাদ মজহার: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাকে বলা হয়? বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলো, যারা জনগণের অলিখিত অভিপ্রায়কে লিখিত রূপ দেয় এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে ও জনগণের অভিপ্রায় সঠিকভাবে গঠনতন্ত্রে প্রতিফলিত হলো কিনা, তা নিশ্চিত করে। এটাই হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ। এটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন কি আইন নেই? নিশ্চয় আছে। সমাজে তো আরও আইন-বিধি লুপ্ত হয়ে যায় না। ফলে জনগণের অভিপ্রায়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ যেসব নৈতিক বিধি-বিধান ও আইন রয়েছে, সেগুলোর সবই চলবে, যদি তাতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সংঘাত না বাধে। এটা জানার পরও যারা ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র নামে পুরোনো রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে চায়, তারা আসলে প্রতিবিপ্লবী। এদের রুখে দিতে হবে।
সমকাল: অলিখিত আইন কোথায় আছে?
ফরহাদ মজহার: এটি আছে জনগণের অভিপ্রায়ের মধ্যে। অলিখিত আইন লিখিত রূপ দিতে যে প্রক্রিয়া রয়েছে, সেটি হলো নতুন গঠনতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়া। নতুন গঠনতন্ত্রের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এটি তো জনগণের অভিপ্রায়ের মধ্যেই আছে। এটি লেখার জন্য কোনো উকিলের দরকার নেই।
সমকাল: আপনি বলেছিলেন, মুহাম্মদ ইউনূসেরই রাষ্ট্রপতি হওয়া উচিত।
ফরহাদ মজহার: আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা মানে, কার উপদেষ্টা? রাষ্ট্রপতির। এই রাষ্ট্রপতি তৈরি হয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের পুরোনো সংবিধান অনুযায়ী। অথচ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকার ও সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে। আমি এ ব্যাপারে সামাজিক মাধ্যমে চারটি বক্তৃতা দিয়েছি। আদতে এর মাধ্যমে তো গণঅভ্যুত্থান নস্যাৎ হওয়ার শর্ত তৈরি হয়। জনগণের অভিপ্রায়ের বাস্তবায়ন হয় না।
সমকাল: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ তো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে গঠিত হয়েছে।
ফরহাদ মজহার: কীসের ভিত্তিতে এ রায় হলো? সুপ্রিম কোর্ট কাজ করে বিদ্যমান সংবিধানের ভিত্তিতে। সেই সংবিধান তো গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। আদালত কীসের ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানের সরকারের বৈধতা ঠিক করে দেয়? আপনাকে আইন ও সার্বভৌম ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক বুঝতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণই হলো আইনের উৎস। আর হাসিনা সরকারের আইনের উৎস ছিল সংবিধান। আজ তাহলে কোনটা আইনের ভিত্তি হবে?
১৯৭১ সালে কি আমরা পাকিস্তানের সংবিধান মেনে দেশ স্বাধীন করেছিলাম? একই জিনিস ঘটেছে। কেন আপনি পুরোনো ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো রেখে দিতে চাচ্ছেন? আমি মনে করি, এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ইস্যু। দেখুন, এর মধ্য দিয়ে আমাদের কী ভীষণ বিপদে ফেলা হয়েছে!
সমকাল: কী বিপদ?
ফরহাদ মজহার: প্রথমত, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’-এর কোনো বিধান হাসিনার সংবিধানে নেই। বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদের আলোকে বিচারপতিদের ‘মতামতের ভিত্তিতে’ বর্তমান সরকারকে ‘বৈধ’ বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ পারলে এসে আদালতে রিট করে দেবে। তারা বলবে, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার অবৈধ। রিট করলে আপনি কী উত্তর দেবেন?
সমকাল: কী করতে হতো?
ফরহাদ মজহার: আমাদের প্রস্তাব ছিল, বঙ্গভবনে নয়, নতুন সরকারের শপথ হবে শহীদ মিনারে গিয়ে। হাজার হাজার জনতার সামনে। কারণ ওখান থেকে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। উৎসবের মধ্যেই মুহাম্মদ ইউনূস বলতেন, ‘আজ থেকে আমি জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। আর যেহেতু আমি জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি, এখন থেকে আমার নির্দেশই আইন এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায় বাস্তবায়নই আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সমকাল: বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ এবং জনতার কাছে গিয়ে শপথের মধ্যে পার্থক্য কী?
ফরহাদ মজহার: নির্বাচিত সরকারে কী ঘটে? সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের শাসন করে। আর সার্বভৌম সরকারে জনগণই জনগণকে পরিচালিত করে। যতক্ষণ পর্যন্ত লিখিত সংবিধান না আসে ততক্ষণ ড. ইউনূস প্রতীকীভাবে সার্বভৌম জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন; সংবিধান নয়। তাহলে তিনি যদি সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি হতে চান, তাহলে অবিলম্বে এই সংবিধান নাকচ করে দিয়ে তাঁকে জনগণের কাছে শপথ নিতে হবে।
সমকাল: যদি জনগণের কাছে শপথ না নেন, তাতে কী অসুবিধা?
ফরহাদ মজহার: তাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিনি বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের রাষ্ট্রপতির ‘উপদেষ্টা’ মাত্র। রাষ্ট্রপতি এখন কথা শুনছেন, যেহেতু ক্ষমতার ভারসাম্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে। কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। একমাত্র ইউনূসের হাতে রাষ্ট্রপতির বা চূড়ান্ত ক্ষমতা এলেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের নির্বাচিত বলে বৈধ গণ্য হবে। এর আগে পুরোনো কাঠামো রেখে যে কোনো সিদ্ধান্ত অবৈধ।
সমকাল: জনতার কাছে শপথ কি বাস্তবসম্মত?
ফরহাদ মজহার: সেনাবাহিনী শেখ হাসিনার নির্দেশ সত্ত্বেও তরুণদের গুলি করেনি। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীও গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল। সুতরাং সেনাবাহিনী মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশ মানতে প্রস্তুত। তিনি আদতে সেনাবাহিনীরও প্রতিনিধি। ফলে মুহাম্মদ ইউনূস যদি বলেন, তিনি জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি, তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে, আইনগতভাবে সম্পূর্ণ বৈধ। ড. ইউনূস ছাত্র-জনতা ও সৈনিকদের মৈত্রীর ভিত্তিতে এই কাজটি অনায়াসে অবশ্যই করতে পারেন। জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে তিনি নিজেকে এই ঘোষণা দিতে পারেন; কোনো অসুবিধা নেই। এখানে কোনো আইনি বাধা নেই।
সমকাল: নতুন সরকার ইতোমধ্যে শপথ নিয়ে নিয়েছে, কাজও শুরু করেছে। এখনও কি জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়ন সম্ভব?
ফরহাদ মজহার: সম্ভব। সেই ক্ষেত্রে মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দিতে পারেন। নইলে যে কোনো মুহূর্তে উল্টাটাও হয়ে যেতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অধিষ্ঠিত ইউনূস নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেলায় জেলায় গিয়ে জনগণকে বলবেন– এটি তোমাদের সরকার। তোমাদের কথা, তোমাদের বক্তব্য তুলে ধরাই আমাদের কাজ। কী ধরনের রাষ্ট্র তুমি চাও, তুমিই বলো। আমরা যদি একজন ব্যারিস্টার ডেকে মুসাবিদা করে এসে বলি, এটি আইন; তা আমরা মানব না। বরং জনগণই বলুক, তারা কোন রাষ্ট্র চায়। জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছা বাস্তবায়নই সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সমকাল: এ ক্ষেত্রে তো দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
ফরহাদ মজহার: এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই, চার, পাঁচ বছর লাগতে পারে, লাগুক। অনেক কম সময়েও করা যায়, যদি আমরা সবাই সহযোগিতা করি। ততদিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকবে। এই সরকারের প্রধান জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনিই জনগণ। তাঁর গায়ে কোনো আঁচড় লাগলে জনগণ তাদের উড়িয়ে দেবে। এই কথা যখনই সবাই বুঝবে, তখন সবাই জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতি মাথা নত করতে বাধ্য।
সমকাল: আপনি কি বিপ্লবী সরকার গঠনের কথা বলছেন?
ফরহাদ মজহার: আমি কি একবারও বিপ্লবের কথা বলেছি? এটি কি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব? যা ঘটেছে, এটিকে ক্ল্যাসিক্যাল ভাষায় বলে বুর্জোয়া ডেমোক্রেটিক রেভ্যুলিউশন। কার্যপদ্ধতি সেভাবেই নির্ধারিত হবে।
সমকাল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী কী সংস্কারে অগ্রাধিকার দেবে?
ফরহাদ মজহার: আমার বইয়ে লিখেছি, ব্যক্তির স্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই। আমরা তার চূড়ান্ত বিজয় চাই। আমরা এমন রাষ্ট্র চাই, যে রাষ্ট্র আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হরণ করবে না, আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করবে না এবং আমাদের মর্যাদা হরণ করবে না। এটিই আমাদের আগামী রাষ্ট্রের ফান্ডামেন্টাল ফিলোসফিক্যাল ফাউন্ডেশন, যেটি বিভিন্ন মানুষের বক্তব্য দ্বারা প্রকাশিত।
সমকাল: তার মানে, আবারও সংবিধানের প্রশ্নটি আসে।
ফরহাদ মজহার: প্রথমত, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার কোনো অধিকার রাষ্ট্র রাখে না। সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন এই এক লাইনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, জনগণের জীবন ও জীবিকাবিরোধী কোনো আইন বা নীতি পাস করার কোনো অধিকার রাষ্ট্রের নেই। রাষ্ট্র কোনোভাবে কর্মজীবী মানুষের অবদান অস্বীকার করার অধিকার রাখে না। আসলে এক পাতার মধ্যে গঠনতন্ত্রের ভিত্তি লেখা হয়ে যায়।
সমকাল: আপনি সরকারের ব্যবহারিক দিকের বদলে নীতিগত দিকে বেশি আলোকপাত করছেন?
ফরহাদ মজহার: আগে আমাদের নীতিগত দিকই ঠিক করতে হবে। এগুলো করে কি ব্যবহারিক সংস্কার করা যাবে না? আপনারা আগেই কেন সংস্কারের কথা বলছেন? আগে সরকারটি বৈধ করেন, তারপর সংস্কার করবেন। সরকার বৈধ না হলে আপনার সব ধরনের রদবদল, সংস্কার অবৈধ হবে।
সমকাল: সে কারণেই কি আপনি প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকির কথা বলেছেন?
ফরহাদ মজহার: আমরা বলি, জনগণের মধ্যে সার্বভৌমত্ব বিরাজ করে। জনগণই সার্বভৌম। তাহলে আপনি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণকে দিচ্ছেন না কেন? তারপর যা খুশি সংস্কার করেন। আপনি যখনই বলবেন, সার্বভৌম জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস জনগণের রাষ্ট্রপতি, তখন সবাই তাঁর মন্ত্রী। কিন্তু দেখুন, এখন আপনি বলছেন, তিনি উপদেষ্টা। কার উপদেষ্টা? রাষ্ট্রপতির। কোন রাষ্ট্রপতি? যিনি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের রাষ্ট্রপতি। ইউনূস সেই রাষ্ট্রপতির প্রধান উপদেষ্টা। এটা কি কিছু হলো? এই উপদেষ্টা বানানোর জন্য কি এত রক্তপাত হয়েছে? সেই জন্য কি আবু সাঈদরা প্রাণ দিয়েছে?
সমকাল: গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তরুণরা এখন কী করবে?
ফরহাদ মজহার: তরুণরা এই বিপ্লব সংহত করবে। ড. ইউনূসের হাত শক্ত করবে। বিভিন্ন জায়গায় তরুণদের বিপ্লবী পরিষদ গড়ে উঠবে। রাষ্ট্র, সংবিধান ইত্যাদির নামে যে প্রতিবিপ্লব চলছে, তা তাদের জানানো দরকার। এগুলো বলার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের নীতি ও কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে পারব। আমরা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ধারা গড়ে তুলতে পারব।
সমকাল: এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ফরহাদ মজহার: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
সমকাল