মতামত

ক্ষমতার অপব্যবহার ও একটি পাপেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনঃ পর্ব ১

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের শোষন-পীড়ন, নির্যাতন সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশি অবগত। দেড় যুগের শাসনামলে দেশের অন্য সকল সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের মতো নির্যাতন এবং বৈষম্যের শিকার হয়েছে – বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রোফেশনালস (বিইউপি) এর অসংখ্য শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীও। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের অবিচ্ছেদ্য শোষক বলয় ভেদ করে আমাদের আর্তচিৎকার কেউ জানেনি। আজ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করেছে, সে সাহসে বলিয়ান হয়েই আমরা বলতে চাই সে সকল অপ্রকাশিত এবং অব্যক্ত নির্যাতন এবং দমন-পীড়নের কলংকিত ইতিহাস।

আজ আমরা বলব, আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন শিক্ষক- খালেদ ইমরান স্যারের কথা।

এই ঘটনার পরিক্রমা মূলত বিগত সরকারের মদদপুষ্ট ২-৩ জন ব্যক্তি কে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল। যারা ক্ষমতার অপব্যবহার, হুমকি, এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিগৃহীত এবং নীপিড়ন করেছে আমাদের শিক্ষকদের এবং শিক্ষার্থীদের। এই ঘটনা প্রমাণ করে “আক্ষরিক অর্থে দেশের এই কথিত অরাজনৈতিক বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবিক অর্থে কিভাবে পাওয়ার পলিটিক্সের একটা “vicious cycle” এ বন্দী।

খালেদ ইমরান স্যারের সাথে ঘটা অন্যায় ও অবিচার এবং কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতার অপব্যবহার (আওয়ামীলীগ সরকার, সামরিক বাহিনীর উচ্চ প্রদস্থ কর্মকর্তাগণ এবং একটি পাপেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন)।

ঘটনার সূত্রপাত- ৬ মার্চ, ২০২২ সাল
অন্য সব দিনের মতোই সেদিন খালেদ ইমরান স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য আগত IR 2021 ব্যাচকে শ্রেণীকক্ষে পড়াচ্ছিলেন History of IR। সেখানে তিনি ফরাসিদের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে Sun King এর অন্যায় অবিচার তুলে ধরেন। সে সময়ে কিভাবে গুটিকয়েক ক্ষমতাসীন শ্রেণি হরণ করেছিলো সাধারণ মানুষের বাকস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার এবং চালিয়েছে ঘৃণ্য নির্যাতন। তারই ধারাবাহিকতায়, শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশে তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বিতর্ক এবং আলোচনার ভিত্তি তৈরি করার চেষ্টা করেন এবং জিজ্ঞাসা করেন বাংলাদেশে পরিস্থিতির সঙ্গে এই ঘটনাগুলোর সাদৃশ্য কতটা? এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশ বলে উঠে “আমরা তো ফ্যাসিজমের মাঝে আছি, বাকস্বাধীনতা আমাদের নেই বললেই চলে”। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন- সামিউজ্জামান সামি, যার বাবা মোঃ সাহিদুজ্জামান খোকন মেহেরপুরের-২ আসনের তৎকালীন এমপি, স্যারের এই মন্তব্যের বিরোধীতা করেন এবং বলেন যে- “আমরা অনেক ভাল অবস্থায় আছি এবং উন্নত রাষ্ট্রের দিকে আগাচ্ছি”।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, সে সময়ে সামি বেশ প্রভাবশালী এবং উগ্র আচরণ করত তার সহপাঠীদের সাথে এবং অন্য শিক্ষকরাও তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে বিব্রত বোধ করতেন। কিছুদিনের মধ্যে তার নীপিড়নমূলক আচরণের বেশ কিছু সঙ্গী-সাথীও জুটে যায়। যার মধ্যে অন্যতম হল- জারিফা বিনতে আলম, যার বাবা বাংলাদেশ আর্মির লেফট্যান্যান্ট জেনারেল সাইফুল আলম, যিনি ২০২০-২১ সালে ডিজিএফআই এর ডিজি হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং ইতিমধ্যে আওয়ামীলীগ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের একনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে অজস্র কুকৃতির হদিস পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে, যদিও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তিনিও আজ সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে।

৮ মার্চ ২০২২
সেদিন ক্লাসে এসে আমরা জানতে পারি, খালেদ ইমরান স্যারের সাথে আলোচনার জন্য তাকে চেয়ারম্যান ও ডিন অফিসে তলব করা হয়েছে এবং স্যারের কাছে এই আলোচনার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা সেখানেই থেমে থাকেনি, তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত বোর্ড (১ নম্বর বোর্ড) গঠন করা হয় এবং সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বেশ কয়েকবার সেই বোর্ডে গিয়ে নানারকম প্রশ্নের জবাবদিহিতা করতে হয়। এই সময়ে IR 2021 ব্যাচের শিক্ষার্থী যারা তদন্ত বোর্ডে নিজেদের স্টেটমেন্ট দিতে যেত, তাদের অনেককেই সামি এবং জারিফা স্যারের বিপক্ষে বিবৃতি দেওয়ার জন্য জন্য জোর করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের মাঝে এই ব্যাপারে অভিযোগকারী সামি এবং জারিফাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা শিকার করে যে, তারা স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে সরকার এবং সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য। অনেক শিক্ষার্থী এই ব্যাপারে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেও তাতে বিশেষ কোনো উপকার হয়নি।
তদন্ত কমিটিতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্যারের পক্ষে জবাব দিয়েছিলো এবং ক্ষমতাসীন অভিযোগকারীদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত না আসায় তারা ওই তদন্ত কমিটিকে বাতিল করে এবং নতুন আরেকটি বোর্ড (২ নম্বর বোর্ড) বসানো হয়।

এক্ষেত্রে জারিফা তার বাবার ক্ষমতা ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কুক্ষিগত করে রাখে, অপর দিকে সামিও এই বিষয় নিয়ে ভিসি ও ডিন স্যারকে বারবার প্রেশার দেয় ( উক্ত কথা গুলা খোদ সামিই নিজের সহপাঠীদের সঙ্গে গর্ব করে বলে)। এই ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, আমাদের অপর একজন নারী শিক্ষক, যাকে নরম এবং ভীতু ভেবে দ্বিতীয় তদন্ত কমিটিতে নেওয়া হয়েছিলো। দিনশেষে তিনিই পরিচয় দিয়েছেন অসম সাহসিকতার। তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তে সম্মত হতে রাজি না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন রাত দশটা পর্যন্ত একটি অফিস কক্ষে আটকে রেখে জোর পূর্বক সম্মতি নেন। এছাড়াও, এই তদন্ত কমিটি সামি এবং তার দোসরদের মতামতকে প্রাধান্য দেয় এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিবৃতি রীতিমত উপেক্ষা করে যায়। এমন কি- বিবৃতি দেওয়ার পর সামি বাহিরে বের হয়ে উল্লেখ করে যে তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যানের সাথে তার ভালোই খাতির হয়েছে, তিনি তাকে ছাড়তেই চাচ্ছেন না কোনো মতে। শিক্ষার্থীদের লিখিত বক্তব্য পরিবর্তন করবার জন্য রেজিষ্টার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মামুন একাধিকবার শিক্ষার্থীদের কল এবং একরকম হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক বিবৃতি খালেদ ইমরান স্যারের বিরুদ্ধে লিখিয়ে নেন। নতুন তদন্ত বোর্ডে সামরিক বাহিনী থেকেও অফিসাররা এসে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং প্রশ্নের বানে বিপর্যস্ত করে ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে একরকম স্বীকার করিয়ে নেন- স্যার দোষী।

বিইউপি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০২১ ব্যাচের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ।

চলবে..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button