‘লাগলে আবার যামু, দরকার হলে আরেকটা হাত হারামু’
পুরনো মানচিত্র। নতুন ছবি। দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি। বহুত্ববাদ আর সাম্যের গান। মুক্তির আনন্দ, হারানোর হাহাকার। নতুন শুরুর স্বপ্ন। যেন ঠিক মুক্তিযুদ্ধের পরের দিনগুলোর গল্প। আমার মতো অনেকের ট্রমা অবশ্য এখনো কাটেনি। ক’দিন ধরেই লেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না।
বিজ্ঞাপন
রোববারের কথাই যেমন বলি। মাথায় পুরো লেখা গুছিয়ে এনেছি। এমন সময় হানা দিলো একটি ছবি। বিএএফ শাহীন কলেজের কক্ষ। পরীক্ষা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। একটি টেবিলে কিছু ফুল। কাগজে লেখা- শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ। এখানে ১৭ বছরের এই তরুণের থাকার কথা ছিল। কিন্তু থাকতে পারেনি। ৪ঠা আগস্ট মিরপুর-১০ নাম্বারে গুলিতে নিহত হয় আহনাফ। তার মতো এমন অনেকেই আর শ্রেণিকক্ষে ফিরতে পারেননি। তারা আর কোনো দিন পারবেনও না। তাদের সংখ্যা কতো আমরা নিশ্চিত করে জানি না। এই শহীদদের ছবি দেখে, এদের গল্প পড়ে ঠিক থাকা যায় না। কিংবা সে ছবিটার কথা। একটি ছেলের গুলিবিদ্ধ হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু তার চোখে-মুখে হাসি। বলছে, ‘লাগলে আবার যামু। দরকার হলে আরেকটা হাত হারামু।’ চোখের পানিতে লেখা এগোতে চায় না।
১৫ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট। অপরিসীম আত্মত্যাগের এক ইতিহাস তৈরি করেছে বাংলার তরুণেরা। মুক্তিযুদ্ধের পর যা আগে কখনো ঘটেনি। ছাত্র-জনতার বলিদান একদিকে তৈরি করেছে বেদনার পাহাড়। অন্যদিকে, নতুন এক দেশের স্বপ্ন। এমনই এক পটভূমিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুরুতে তিনি রাজি ছিলেন না। শিক্ষার্থীদের বারবার অনুরোধে সায় দেন। শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্যও তৈরি হয়েছে। কোনো দল বা ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়নি।
এটা সারা দুনিয়াতেই ঘটেছে। বিপ্লবের পর এক ধরনের অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি আর অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ভিনদেশি কূটনীতিকদের কাছে দেয়া বক্তব্যে তার সরকারের অবস্থান পুরোপুরি স্পষ্ট করেছেন। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন যে সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে সেটা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, সংস্কারের পর একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কিছু সুপারিশ রাখতে চাই সব মহলের প্রতি।
আগেই বলেছি, অপরিসীম ত্যাগ আর তিতিক্ষার বিনিময়ে নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। কতো ছাত্র-জনতা এ সংগ্রামে নিহত হয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। শহীদদের একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রণয়নে সরকারকে কাজ করতে হবে। তাদের পরিবারকে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। বহু মানুষ চোখ হারিয়েছেন। আহতদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে। অবশ্য এরইমধ্যে এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনায় কখনো কখনো হয়তো কিছুটা কঠোরতারও প্রয়োজন হয়। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পটভূমিতে কেউ কেউ সুযোগ নেয়ার চেষ্টাও করছেন, বিশেষত সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা। কারিগরি ত্রুটি না থাকলেও কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে মেট্রোরেল এ লেখার সময় পর্যন্ত চালু করা যায়নি। এমন অনেকেই দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে যৌক্তিক হলে মেনে নেয়া এবং অযৌক্তিক হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
সরকারের এখন প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরানো। অর্থ, পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে দেশসেরা মানুষরা কাজ শুরু করেছেন। যদিও তারা অর্থনীতিকে খুবই বাজে অবস্থায় পেয়েছেন। ব্যাংকগুলো ভেঙে পড়েছে। এস আলম গ্রুপ একাই প্রায় পুরো ব্যাংক খাত খেয়ে ফেলেছে। এ গ্রুপ তাদের নিয়ন্ত্রিত ছয়টি ব্যাংক থেকেই ৯৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এরসঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এটিও খেয়াল রাখতে হবে নতুন কোনো এস আলমের যেন জন্ম না হয়। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এরইমধ্যে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ফেরাতে হবে। পুলিশে দুর্নীতি যেন কিছুতেই না ফেরে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান সরকারের প্রধানতম ম্যান্ডেট হচ্ছে জুলাই-আগস্ট হত্যাসহ গুম-খুনে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা। সরকারকে সে কাজ করতে হবে আইনের যথাযথ অনুসরণে। জুলাইয়ে কী হয়েছে তা একেবারেই স্পষ্ট। ভিডিও প্রমাণ করে কীভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সমালোচিত বা বিতর্কিত আইনে বিচারের ক্ষেত্রে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করাই উত্তম। যেন কেউ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। গণহারে মামলা না করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা হওয়া উচিত। জুলাই-আগস্ট হত্যা, গুমে যারা স্ট্রাকচারে জড়িত ছিলেন তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। তবে বন্দিদের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। গল্প না সাজিয়ে সত্য তথ্য প্রচার করতে হবে। অভিযুক্তরা যেন আইনজীবী নিয়োগসহ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান তা নিশ্চিত করতে হবে। ইতিমধ্যে তার কিছু ব্যত্যয় ঘটেছে।
প্রধান উপদেষ্টা নিজেও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। স্বৈরশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। বিশেষত নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে সৎ ও দক্ষ বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। এমন ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হবে যাতে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পথ কেউ বন্ধ না করতে পারে। বিচারবিভাগে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর করতে হবে।
ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। শুধু অতীতের দুর্নীতির বিচার করলেই চলবে না। এখনো কারও বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত বিচার করতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, রাস্তায় কাউকে ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা মিডিয়াতেও সংস্কারের কথা বলেছেন। এটি কীভাবে সম্ভব সে ব্যাপারে তিনি নিরপেক্ষ, সৎ সাংবাদিকদের পরামর্শ নিতে পারেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এতে বাধা দেয়া কালাকানুন বাতিল করতে হবে। মুক্ত সাংবাদিকতার বিকল্প কিছু নেই। সাংবাদিকরা যেন নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেন তার গ্যারান্টি দিতে হবে।
আন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই যোগ দিয়েছে। কিন্তু এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সমন্বয়করা এ আন্দোলনের মুখ। ইতিমধ্যে তারা ইতিহাস তৈরি করেছেন। তবে বিপ্লব শেষ হয়ে যায়নি। বিপ্লব পূর্ণ করার জন্য তাদের সামনে আরও অনেক পথ রয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধেও যদি কোনো অভিযোগ আসে তাদের তা শুনতে হবে। অভিযোগের সুরাহা করতে হবে দ্রুত।
এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যা ঘটা উচিত হয়নি। যেমন: সমন্বয়করাই এটা নিশ্চিত করেছেন যে, কারও মোবাইল চেক করা, ব্যাগ চেক করার অধিকার অন্যদের নেই। আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন, বই পোড়ানোর মাঝে, ভাঙচুরের মাঝে কল্যাণ নেই। প্রয়োজন নতুন সৃষ্টির।
রাজনীতিবিদের বুঝতে হবে, তরুণরা কী চায়। নিজ নিজ দলে সংস্কার আনতে হবে তাদের। দলের নামে যারা অপরাধে জড়িয়েছে, জড়াচ্ছে তাদের বাদ দিতে হবে।
শেষ কথা: এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর নবযাত্রা শুরু করেছে দেশ। এই যাত্রায় ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। নতুন দেশ, নতুন রাষ্ট্রের বিনির্মাণ চান সবাই। বিপ্লব যেন আর কোনো দিন বেহাত না হয়। শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার হোক নয়া বাংলাদেশের ভিত্তি।
-সাজেদুল হক