মতামত

আ’লীগ ও বাংলাদেশের জনগণের উপর প্রতিশোধ নিলেন শেখ হাসিনা?

কথাগুলো ব্যক্তিগত, কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু
বাংলাদেশে জন্মগ্রহণের সূত্রে ২৯ বছর একটানা কেটেছে দেশে, সেই সময়ে ছাত্র জীবনে এবং তার পরে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিলো কমপক্ষে ১০ বছর। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মিছিলে শামিল হয়েছি, ডাকসু’তে নির্বাচিত হওয়ার সূত্রে মিছিলের আগে থেকেছি, পেছনেও থেকেছি। পুলিশের নির্যাতন দেখেছি, তার শিকারও হয়েছি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা থেকেই একটা বড় সময় কেটেছে রাজপথে, কারাগারে কেটেছে কিছু সময়। নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে মানুষকে দাঁড়াতে দেখেছি, দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি; আন্দোলনের সময় রাজপথে গুলিতে নিহত হতে দেখেছি, আহতকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটেছি গুলির ভেতরে।

মিছিলে পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া পুলিশের ট্রাক মিছিলের সহযাত্রীকে পিষে দিয়েছে, সেই দৃশ্য দেখবার দুর্ভাগ্য হয়েছে। তারও আগে কৈশোরের অভিজ্ঞতার বড় দিক হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, তার ভয়াবহতা, তাতে স্বজন হারানোর বেদনা সবই আছে। রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা এবং পারিবারিক পরিবেশের কারণে কৈশোর ও তারুণ্যের সময় থেকেই রাজনীতির তত্ত্ব বুঝতে চেয়েছি, ইতিহাস পাঠ করেছি। তার পরে একাডেমিক কারণে ১৯৮৭ সাল থেকে রাজনীতি বোঝার অংশ হিসেবেই শুধু নয়, নৈতিক দায়িত্বের বোধ থেকেও বাংলাদেশকে বোঝার চেষ্টা করেছি, গবেষণা করেছি, বিশ্লেষণ করেছি। সাংবাদিকতায় পেশাগত জীবনের সূচনা হয়েছিলো, দীর্ঘ দিন পরে সেখানে ফিরেছি বিবিসি’তে কাজ করার সূত্রে। সেই সময় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশ দখলের যুদ্ধ, সংঘাতের খবরের ভেতরেই কাটিয়েছি পাঁচ বছর।

কিন্ত … বিশ্বাস করুন … আমি আমার সমস্ত আন্তরিকতা নিয়ে বলছি … জুলাই মাসের ১৬ তারিখের পর থেকে ছাত্র আন্দোলন যখন ছাত্রজনতার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে সেই সময়ে পুলিশের নির্মমতার চিত্র যতই দেখি ততই ভাবি এর কী ব্যাখ্যা? এই নির্মমতার সামান্যই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে। এখন প্রায় প্রতিদিন সেই সামান্যরও কিছু কিছু ভিডিও আস্তে আস্তে ফেসবুকে প্রকাশিত হচ্ছে। সেগুলোর ভেতরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের যে জিঘাংসার চেহারা তা দেখে শিউড়ে ওঠার মতো, বিশ্বাস করতে পারিনা এটাই আমার জন্মভূমি। এইসব ভিডিও’র প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা করে বর্ণনা দেয়া যায়, হৃদয়ের প্রত্যেকটা তন্ত্রী ছিঁড়ে যাওয়া সত্বেও বর্ণনা দেয়া যায়। এগুলো আমি-আপনি দেখেছি। কোনও বর্ণনা, কোনও ভাষাই এই নির্মমতা, এই বর্বরতাকে তুলে ধরতে পারবেনা।

‘গুলি করলে মরে একটা, বাকিডি যায় না’ বলার সময় পুলিশের ওয়ারি বিভাগে উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মাদ ইকবালের নির্লিপ্ততাকে ছাপিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে যাকে আমরা জানতাম সেই মো. আছাদুজ্জামান খান কামালের দিকে লক্ষ্য করে দেখেছি, একজন মানুষ – দায়িত্ববান মানুষের কথা বাদই দিলাম – এমন নিস্পৃহ থাকতে পারে সেটা না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম কিনা জানিনা। মনে হয়েছে এই সব মানুষ কী তাঁদের পরিবার-পরিজনের কথা ভাবেন না। ৫ আগস্ট চানখারপুলে যে পুলিশেরা বলে “মরছে? একটা মরছে? ঠিক আছে ফালাইয়া দে” তাঁর কারা?

যে পুলিশেরা আসহাবুল ইয়ামিনের অর্ধমৃত শরীর সাজোয়া যান (এপিসি) থেকে ফেলে দিয়েই নিরস্ত হয়না তাঁকে ডিভাইডারের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নির্বিকারভাবে চলে যায় তাঁরা কারা? জনগণের করের টাকায় তৈরি পোশাক পরিহিতদের মধ্যেই কি এই জিঘাংশা ছিলো? পুলিশের গুলিতে আহত অবস্থায় মৃত্যুপথযাত্রী নাফিসকে নিয়ে রিকশা চালক ফার্মগেট হাসপাতালে যেতে পারেননি, পত্রিকার ভাষায় ‘বাধার মুখে সেখানে ঢুকতে পারেননি’। এই যে বাধাদানকারীরা তাঁরা কারা? শুধু তাই নয়, এই ভয়াবহ হত্যালীলার সময় যারা উৎসাহ জোগালেন, এর পথ তৈরি করতে বছরের পর বছর উৎসাহ দিলেন যাদের পরিচয় শিক্ষিত বলে তারাই বা কারা?

জার্মানীতে হিটলারের যে বাহিনী জেনোসাইডে যুক্ত ছিলো তাঁদের একটি ইউনিট সম্পর্কে বলা হয় ‘উইলিং এক্সিকিউশনার’ – ইচ্ছুক ঘাতক। বাংলাদেশ যে এইসব ইচ্ছুক হত্যাকারী তৈরি হয়েছিলো, আছে – এখনও যারা অবিরতভাবে বলে চলেছেন এমন সব কথা যেন এই হত্যার মহোৎসব ঘটেই নেই, তাঁদের এই মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হল কীভাবে? তত্ত্ব দিয়ে, তথ্য দিয়ে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা বিভিন্ন দেশে কেমন তা বোঝা এবং বোঝানোর চেষ্টা করি অনেক দিন। কিন্ত এই যে হত্যালীলা তাকে মনে হয় প্রতিহিংসার উন্মত্ততা। যেন মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। যেন বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছিলো ভিন-দেশী শত্রু। যুদ্ধেরও নিয়মকানুন থাকে, কিন্ত ভালো করে তাকিয়ে দেখুন ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে যুদ্ধ, যে ম্যাসাকার, যে কার্নেজ তার কোনো নিয়ম নেই।

শেখ হাসিনার অনুসারীরা, যারা ব্যক্তি পুজায় এতটাই নিবেদিত ছিলেন/আছেন তাঁরা কি আসলে তাঁদের আরাধ্য নেত্রীর আদলে নিজেদের গড়ে তুলেছিলেন/তুলেছেন। শেখ হাসিনা যে তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে একধরণের ঘাতকে পরিণত করতে পেরেছিলেন তা কি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসারই অংশ? যে ‘অকৃতজ্ঞ জাতি’ তাঁর পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর নিরব থেকেছিলো তাঁদের প্রতি তাঁর যে ডিসডেইন (বিরক্তি, ঘৃণা) সেটাই কি তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের উইলিং এক্সিকিউশনারে পরিণত করেছে? তত্বের ভেতরে তার উত্তর হয়তো আছে, হয়তো নেই; কিন্ত ব্যক্তি হিসেবে ভাবি এই ভয়াবহতার যে ট্রমা তা এই জাতিকে কতদিন বইতে হবে? ভাবি যারা এখনও উইলিং ইক্সিকিউশনার হয়ে আছেন তাঁরা কি আদৌ বুঝতে পারছেন তাঁরা কোথায় আছেন?

–আলী রিয়াজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button