প্রবাস

জুলাই অভ্যুত্থানের নায়ক যখন রাজনীতির মাঠের খেলোয়াড়

ডেস্ক রিপোর্ট:
সেনা সদরের বরাতে নেত্রনিউজ অনলাইনের খবরটি সেহরির সময় (রবিবার) পেয়েছি। জানা গেল, জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ যেই দাবি বা অভিযোগ করেছেন, তার সব সত্য নয়। যদিও সেনা সদরের ঐ ব্যাখ্যা ছিল খুবই সহনশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ। আর সকালে এনসিপি নেতা সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্ট পড়ে আপাতত এই ঘটনার তথ্যগত অস্বচ্ছতা অনেকটা দূর হয়।

ভুল বুঝতে পারা বা আত্মসমালোচনা বা আত্ম উপলব্ধি ব্যক্তির অন্যতম গুণাবলী। এতে ছোট হয় না, বরং বড় মনের পরিচয় প্রকাশ পায় । সেনাবাহিনী নিয়ে আগের দিন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্যের কিছু বিষয় সঠিক নয়, এমন ব্যাখ্যা দিয়ে সারজিস আলমের প্রতিক্রিয়া সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এছাড়া আগের রাতে দলটির নেতা নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীও বলেছিলেন, এমন স্পর্শকাতর বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা প্রকাশ্যে তুলে ধরা সঠিক হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে বা গেল কয়েক বছর অনেকের মধ্যে একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে, জ্বালাময়ী কথা বা বক্তব্য দিতে পারলেই নিজেকে হিরো মনে করেন। কিন্তু সব সময় তো আপনার স্থান সিনেমা হল নাও থাকতে পারে, এটা খেয়াল রাখা উচিত। আবার কোন কারণ ছাড়াও যদি কাউকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করা যায়, তাহলে হাততালি পাওয়া একেবারে সহজ। কিন্তু চিন্তা করি না, যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী কথা শুনে হাততালি দিলাম, তাতে আমার কী লাভ অথবা দেশের কতটুকু লাভ বা ক্ষতি।

শনিবার দিনভর হাসনাত আব্দুল্লাহর ফেসবুক স্ট্যাটাস ও ব্রিফিং-এ দেয়া বক্তব্যের পর অনেকেই হাসনাত আব্দুল্লাহকে আকাশে উঠিয়ে ফেলেছিলেন। যারা হাততালি দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন, অথবা হাততালি দেয়ানোর ক্ষেত্র তৈরি করছেন, দেশের ভিতরে যেমনি আছেন, আবার তাদের বেশির ভাগ বিদেশে থাকেন। আবার এই হাততালি দেখে খুশিতে লাফালাফি যালা করেন, তাদের বেশির ভাগ প্রিয় প্রবাসী কর্মী বন্ধুদের কেউ কেউ। যারা সারাদিন কঠিন পরিশ্রম করে, সময় পেলে ঐ তালির তালে তাল মিলাতে গিয়ে লাফালাফি করতে করতে নগ্ন করে ফেলছেন নিজেকে, মাঝে মাঝে পরিবারের মর্যাদাও।

তালি ও লাফালাফি না দেখে দিনের উত্তপ্ত রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে যোগ বিয়োগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু হিসাব মিলছিলো না কোন ভাবেই। এজন্য নিজের পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি কয়েকজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করি।

প্রশ্নগুলো ডালপালা মেলতে থাকে, যেমন –
_ ১১ মার্চের আলোচনা কেন ২১/২২ মার্চ প্রকাশ্যে আসবে এমন বাক্য ও শব্দ ব্যবহার করে।

_সাধারণত নিকত অতীতে সশস্ত্র “বাহিনী” প্রসঙ্গে কোন রাজনৈতিক দল এমন প্রকাশ্যে সমালোচনা করা দেখিনি।

_ আবার একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্র বা সরকারের বিভিন্ন পক্ষ আলোচনা করে, কথা বলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও আলোচনা হয়। সব কথা কখনোই বাইরে প্রকাশ করে না।

_আমার নিজের এই অল্প সময়ের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদস্থদের সঙ্গে কথা বলেছি। কতো ধরণের কথা হয়েছে বা হয়। যেগুলো এক দিনেই ভাইরাল। কিন্তু কোন দিন প্রকাশ পাবে না বলেই কিন্তু তাঁরা সেই আলোচনা করেন।

_ ৩ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা বিবিসি বাংলার সাথে ইন্টারভিউতে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না? এমন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা পরিস্কার বলেছেন, “নাগরিক হিসেবে যে যার দল, রাজনীতি সবকিছু করবে। আমি বাধা দিতে পারি না। কিন্তু যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হবে, এটুকুই।”

_কিন্তু সেদিন তো কোন আপত্তি দেখা যায়নি। এমনকি কারো তেমন কোন প্রতিক্রিয়াও চোখে পড়েনি।

_আবার সরকারের উপদেষ্টা পদে থেকে আসিফ মাহমুদ একই সময় ২২ মার্চ একটি ভিডিও বার্তায় সেনা প্রধানের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন। যেটা সরকারের একজন উপদেষ্টা হয়ে _এমন মন্তব্য বা এতো দিন পর প্রকাশ্যে এই অভিযোগ করা, এটাই বিষ্ময়কর।

_এর ২/৪ দিনের মধ্যে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের একটি বই প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশনী। সেই বই নিয়ে বিতর্ক চুড়ান্ত পর্যায়ে যখন, সেই সময়ে সেনাবাহিনী ইস্যুটি চলে আসে সামনে।

_ঐ বইয়ে অনেক বিতর্কিত তথ্য এবং বিভিন্ন জনের আপত্তি আছে এমন বক্তব্য তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম প্রসঙ্গে একাধিক স্থানে ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। যেগুলো আবার নিজেরাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করেছেন।

_বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং হয়েছিল, সেই মিটিং ও মিটিং এর কথা বার্তা নিয়ে ভুল তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বইটিতে। আবার ইসলামী ছাত্রশিবিরের যে কয়জন প্রকাশ্যে ছিলেন তাদের ভূমিকা গুরুত্ব দেয়া হয়নি বইয়ে।

_ নতুন ইস্যু সামনে আসায় বইটির ভুল ও আংশিক তথ্য কিন্তু সংশোধনের আলোচনা উধাও। তার মানে আগামী প্রজন্মের কাছে এই বই ২৪ এর অভ্যুত্থানের ইতিহাস হিসেবে থেকে গেল কিন্তু।

_বইটি যখন আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল সেই দিনগুলোতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান ওয়াসায় নিয়োগের সেক্ষে কোটা প্রথা উধাও করে দেয়া হয়। তবে “সুপারিশ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে” বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

_ সেই সময়ে সিটি কর্পোরেশনে কাউন্সিলরদের স্থানে অনিয়ম এবং মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে প্রশাসক নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে, এমন সংবাদ নিয়ে তোলপাড় চলছিল।

_ সেগুলোর কিছুই আমাদের মনে নেই, আলোচনায় নেই। কিন্তু বইটিতে লেখকদের মনের মতো ইতিহাস পাকাপোক্ত রয়েই যাচ্ছে।

এতো সব প্রাতিষ্ঠানিক অস্থিরতায়, এনসিপি ও সেনাবাহিনী ইস্যু আরো অস্থিরতা সৃষ্টি করে । এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর শনিবার ফেসবুক পোস্ট ও ব্রিফিং-এ তার মন্তব্য এবং রাতে আরেক নেতা নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীর প্রতিবাদ আর সেই বৈঠকে উপস্থিত থাকা এনসিপি নেতা সারজিস আলম রবিবার ফেসবুক পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্যের বেশ কিছু বিষয় নাকচ করেছেন। একইসাথে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মোটাদাগে আগেরদিন সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধানকে হাসনাত আব্দুল্লাহর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে স্লোগানও দিতে দেখা গেছে কিছু মানুষকে।

পরদিন উল্টো, সারজিস আলমের কথার সারমর্ম হলো, সেনা প্রধান কোন চাপ দেননি। তাদের ডেকেও নেননি। এনসিপি নেতারাই বেশ কিছুদিন আগেই আলোচনার জন্য সময় চেয়েছিলেন। আর আওয়ামী লীগের বিষয়ে সেনাপ্রধান নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। একই সাথে অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু প্রসঙ্গ তুলেছেন। কিন্তু হাসনাত আব্দুল্লাহ গোপনীয় বৈঠক এভাবে সবকথাই ভিন্ন ব্যাখ্যাসহ প্রকাশ করায় ভবিষ্যতে তাদের দল বা নেতারা আস্থার সংকটের আশঙ্কা থাকবে।

এরই মধ্যে রাজনীতি বিশ্লেষক ও বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকেই গণমাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য এনসিপি নেতারাই তাদের অপরিপক্ক মানসিকতা প্রকাশ করেছেন। এমন ঘটনা দেশের ভিতরে অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেক বিশ্লেষক।

কথা হলো, এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে দলের সবাই আলোচনা না করে মতামত দেয়া কেন। তাও প্রকাশ্যে, বিতর্কিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ক্ষেত্র কেন তৈরি করা হয়েছে? ব্যক্তি এক বিষয়, রাজনৈতিক সংগঠন আলাদা। রাজনৈতিক দল সাধারণ মানুষের আশা প্রত্যাশা, অভিযোগ, দোষারোপ সব কিছু বিবেচনা করতে হয়। একটি রাজনৈতিক দল কখনোই বলতে পারবে না যে, এটাই সবাইকে মানতে হবে, এটাই হতে হবে! কোন একটি দল গোটা জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। সেই দল যতো বড় বা ছোট।

এজন্য জুলাই অভ্যুত্থানের হিরো আর রাজনৈতিক দল এনসিপি’র নেতা কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। এখন কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য বা সমন্বয়ক পরিচয়ে কোন পদ প্রাসঙ্গিক নয়। এই প্ল্যাটফর্মটি বহু ভাগে বিভক্ত হয়েছে আরো আগেই। গঠিত হয়েছে, একাধিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি নেতারা হচ্ছেন দেশের সবচেয়ে নতুন, অনিবন্ধিত, অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নেতাদের একটি রাজনৈতিক দল। এটা অনুধাবন করে সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য, মাঠে ময়দানে কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

একইসাথে যদি গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখা যায়, তাহলে সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সমাজে নেতৃত্ব দিতে চাইলে , নেতৃত্ব ধরে রাখতে হলে, অবশ্যই নবীনদের মাথা ও কথাবার্তার সঙ্গে প্রবীণদের মগজও যুক্ত করার চেষ্টা থাকতে হবে। সেই ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রমাণ দিতে পারলে, হয়তো বারবার দুঃখ প্রকাশ করতে হবে না। কারণ, ভুল স্বীকার করা উদারতা ও বড় মনের পরিচয়। কিন্তু সেটা কতবার এবং স্থান কাল ও পাত্র বড় ইস্যু।

লেখক:

মিরাজ হোসেন গাজী, বিশেষ প্রতিবেদক, বাংলাভিশন৤
২৩ মার্চ ২০২৫।

Source: প্রবাস বার্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button