পুলিশকে নিয়ে নিউজ শেয়ার করায় আয়নাঘরে ঠাই হয়েছিল সাঈদ আবরারের
পুলিশকে নিয়ে শুধু একটি নিউজ শেয়ার করার অপরাধে আমাকে গুম করা হয়। যেতে হয় আয়নাঘরে। যেখানে চলে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ঘটনার বিশদ বিবরণ লিখতে পারবোনা। লেখার মেজাজ বা ইচ্ছেও নেই। খুঁটিনাটি সব লিখতে গেলে প্রয়োজন শত শত পৃষ্ঠার। আবার এমন অবিশ্বাস্য সব ঘটনা আছে, যা হয়তো আপনি কিছুতেই মানতে চাইবেন না। আবু গারিব বা গুয়ান্তানামোর কথা আপনি শুনেছেন, কিন্তু আপনার বাড়ির পাশে এমন মর্মান্তিক জিন্দান থাকতে পারে দুঃস্বপ্নেও হয়তো তা ভাবেননি। কিন্তু প্রতিটি মজলুম এই বাস্তবতার সাক্ষী। ওই সময়গুলোতে যে অভিনব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, যতো নির্মমতা সয়েছি, শুনেছি-জেনেছি নৃশংসতার যতো গল্প- শব্দে-বর্ণে সেসব উৎকীর্ণ করা কোনোভাবে সম্ভব নয়।
–আমার মূল আইডি, যেটি এখনো আয়নাঘরের মালিকদের হাতে : https://www.facebook.com/jashimuddinah
(এ আইডিতে দয়া করে রিকুয়েস্ট পাঠাবেন না)
।।
সূত্রপাত
২০১৭ সালের এপ্রিল। মাত্র গতকাল বাজারে এসেছে সিরিয়া সিভিল ওয়ার নিয়ে লেখা আমার বই ”সিরিয়া মহাযুদ্ধেরকাল”। আগেরদিন প্রি-অর্ডারের বইগুলো পাঠাতে বেশ ঝক্কি ঝামেলা গেছে। পরদিন তাই সারাদিন বাসায় ছিলাম। বিকেলে বাসার সামনের টঙ থেকে চা খেয়ে গলিতে পায়চারি করছি। এসময় হুট করে কোত্থেকে কয়েকজন এসে চারদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরে। ভিড়ের মধ্যে একজন কোমরে কিছু একটা গুজে দিচ্ছে আচঁ করতে পেরে খপ করে লোকটির হাত ধরে ফেলি। হৈচৈ বেঁধে গেলে এগিয়ে আসে কিছু প্রতিবেশী৷ পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেয়ে দ্রুত পিস্তল বের করে ভয় দেখায় আগন্তুকেরা। ভড়কে গিয়ে জনতা পিছিয়ে যায়। এ সুযোগে পকেট থেকে ‘ডিবি’ লেখা আইডি বের করে অপহরণকারীদের একজন। এবার আমার হাত দুটো পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ লাগায় আর কালো গ্লাসে মোড়ানো একটি গাড়িতে উঠিয়েই শুরু হয় নির্দয়ভাবে পেটানো। ‘মিশন হেরোইন’ ব্যর্থ হওয়ার শোধ নিচ্ছিল বোধহয়! একটুও টু শব্দ না করে সহ্য করি প্রাথমিক এই আতিথিয়েতা!
।।
আয়না ঘরের দিনগুলি
আমার বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া ল্যাপটপ, সাথে থাকা মোবাইল, সোশ্যাল একাউন্ট, মেইল সবকিছু তন্নতন্ন করে কয়েকদিন ধরে চলে জ. বানানোর অপচেষ্টা। কিন্তু কোনো ক্লু না পেলে শুরু হয় অন্যধরনের নির্যাতন ও মানসিক হেনস্তা। ঠান্ডাজনিত সমস্যা সত্ত্বেও প্রচন্ড হিটে এসি চালিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা আর বিনোদনের অন্যন্য মাধ্যমে পরিণত করা হয় আমাকে। কিছু সময় পর কোনো এক হর্তাকর্তা আসছে। কিল-ঘুষি আর গালিগালাজের মাধ্যমে পরিচিত হচ্ছি তাদের সঙ্গে। কেউ কেউ সখেদে বলছে, ‘কত্ত সাহস!! পুলিশের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস!’ ইন্সপেক্টর পদবির একজন চুলের মুঠি ধরে সজোরে থাপ্পড় মেরে বলে, ”ব্যাটা, দ্যাশটা পুলিশের বাপের না, পুলিশের নিজের”।
।।
খাস কামরায় খাস লোক
অনিশ্চয়তায় কেটে যায় আরো ক’টি দিন। হঠাৎ একদিন ডাক আসে। যেতে হবে কোর্টে। ডিবির একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে আদালতে নেওয়া হয়। কী মামলা, কী বিষয়-আশয় তখনো জানি না মাথামুণ্ডু!
সারা জীবন কোর্ট-কাচারি এড়িয়ে চলেছি। অথচ তখন দাঁড়িয়ে আছি ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায়। আমার সঙ্গে আরো এক আসামি। চুরির মামলা। চোরের ডান হাত আর আমার বাম হাত একই হ্যান্ডকাফে আটকানো। কোমরে মোটা দড়ি ছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের কামরায় ঢোকার আগে অবশ্য দড়ি খুলে দিয়েছে। চোরের পক্ষে শুনানি করে তার উকিল। আমার পক্ষে কথা বলবার কেউ ছিলো না। ছিলো না উকিল নিয়োগের সুযোগও।
দশদিনের রিমান্ড আবেদন করে সঙ্গে আসা পুলিশ। পুলিশের দেওয়া কাগজ পাতি ঘেঁটে ম্যাজিস্ট্রেট চুপ করে কিছুসময় আমার দিকে চেয়ে থাকে। এরপর জিজ্ঞেস করে, ‘স্ট্যাটাস আপনি দিয়েছেন?’ ‘হ্যাঁ’, বলতে জানতে চায় ঘটনার আদ্যোপান্ত। গুম থেকে শুরু করে এপর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব খুলে বলি। সব শুনে ম্যাজিস্ট্রেট খসখস করে ফাইলে কিছু একটা লেখে। এরপর পুলিশের দিকে তাকিয়ে নিরাসক্ত গলায় বলে, ‘একদিনের রিমান্ড। সতর্কতামূলক জিজ্ঞাসাবাদ।’ আমার দিকে ফিরে আরো দু’বার কথাটা বলে লোকটা। আমি তখন অনুচ্চশব্দে দরুদ-ইস্তেগফার পড়ে চলেছি। হায়েনার ঘেরাটোপে বন্দী অসহায়ত্বের দিনগুলোতে দরুদ-ইস্তেগফারই ছিলো একমাত্র সম্বল। আয়না ঘরে ফিরে এলে সহ-বন্দীরা জানায়, ‘সতর্কতামূলক জিজ্ঞাসাবাদের’ অর্থ মারধর করতে পারবে না।
।।
জামিন অযোগ্য সহজ মামলা!
তেলাওয়াত ও ইস্তেগফারে নির্ঘুম রাত ভোর হয়৷ পরেরদিন রিমান্ড। সকাল হতে নাম ধরে ডাকে। অমুক পিতা তমুক। আগের রাতে আয়নাঘরে নতুন কিছু অতিথি এসেছে। একজনের চেহারা দেখে মনে হলো আগেও দেখেছি কোথাও। কিন্তু বহু চেষ্টার পরও চেনাজানা কারো সঙ্গে তাকে মেলাতে পারিনি। শান্তশিষ্ট ছেলেটি সারা রাত মগ্ন ছিলো দোয়া ও তাহাজ্জুদে। লোকজন সরে গিয়ে যেতে দেয়। লকআপ থেকে বের হলে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দু’জন দু’পাশ থেকে শক্ত করে ধরে। আয়নাঘর থেকে গন্তব্য সিটিটিসির জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ। গায়ে হাত না উঠিয়েও কীভাবে কাউকে লাঞ্চিত ও হেনস্তা করা যায় এখানে মুখোমুখি হই সেসব অভিজ্ঞতার।
রিমান্ড শেষ হলে আয়না ঘরে ফেরৎ পাঠানোর আগে এডিসি পুরো বিষয়গুলোর জন্য ‘দুঃখপ্রকাশ’ করে! বলে, ‘সহজ একটা মামলা দিয়েছি। যাতে আপনার দ্রুত জামিন হয়ে যায়।’ অবশ্য কারাগারে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মামলা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কেস কার্ড হাতে এলে দেখি ‘তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) জামিন অযোগ্য ধারা’। (পরবর্তীতে বিতর্কিত আইনটি বাতিল হলেও মামলা বাতিল হয়নি। বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা বিচারাধীন৷)। ম্যাজিস্ট্রেটের চাহনির মাজেজাও তখন বুঝতে পারি। ‘জামিন অযোগ্য’ সহজ মামলা!!
।।
টাকা দিবি না মামলা খাবি
ব্যারিস্টার মওদূদ আহমদের ল ফার্মের সহায়তায় জামিন মেলে হাইকোর্ট থেকে। মাঝখানে একবার জামিন বাতিলও হয়। জামিনে বেরুলেও শেষ হয় না হয়রানি। এটা ওটা হুমকি-ধমকি। অব্যহত থাকে দফায় দফায় টাকা আদায়। ভাইয়াকে নিষেধ সত্ত্বেও ভ্রাতৃত্বের কারণে শোনতেন না কিছুই। এমনকি একবার ব্যাংক থেকে লোন নিয়েও টাকা দিয়েছিলেন মামলার আইও-কে। আরো মারাত্মক ব্যাপার ঘটতে থাকে। বইয়ের প্রকাশক এবং ফ্রেন্ডলিস্টের বন্ধু অনেকের কাছ থেকে ওরা হাতাতে থাকে মোটা অঙ্কের অর্থ। টাকা না দিলে নাম উঠবে চার্জশীটে। হয়ে যাবে আসামী!!
।।
কিস্তিতে লুটমার
একজন সদ্য ছাত্রত্ব শেষ করেছে। তার কাছে দাবি ৫০ হাজারের। বেচারা মওলানার পক্ষে অতো টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। পরিবারকেও ভয়ে বলতে পারছিলো না কিছু। ও তখন টুকটাক অনুবাদের কাজ করে। পরে ওই টাকা থেকে তিন কিস্তিতে টাকাটা পরিশোধ করে। শেষের কিস্তি এসআই’র সদ্যজাত ছেলের আকিকার দোয়া পড়িয়ে ১২,৫০০/- দেয়। পঞ্চাশ হাজার পুরো উসুল, সঙ্গে হুজুর দিয়ে মোনাজাত করানোর খরচা থেকেও বেঁচে যায় ওই হারামজাদা!!
।।
শেষ হবে লাঞ্ছনা?
জেল খেটেছি প্রায় পাঁচ মাস। আট বছর ধরে দিচ্ছি হাজিরা। ঘুরছি কোর্টের বারান্দায় বারান্দায়। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পেরিয়ে মামলা এখন সাইবার ট্রাইবুনালে। জুলাইয়ের শুরুতেও হাজিরা দিয়েছি। অসুস্থ শরীর নিয়ে লোহার খাঁচায় দাঁড়িয়ে থেকেছি প্রায় দু’ঘন্টা। সামনে রাখা চেয়ার খালি থাকলেও বসবার অনুমতি নেই আসামীর!
নিপীড়ক হাসিনার পতন না ঘটলে হয়তো এবছরই দিয়ে দিতো রায়। সামনে কী হবে জানি না। কেউ বলছে আইন বাতিল হবে। কেউ সংশোধনের কথা। এতে হয়তোবা মামলা বাতিল বা হাল্কা হয়ে যাবে। কী হবে কিছুই জানি না। কোনো কিছুতে আস্থাও নেই। আয়নাঘরে যে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছি, সেই ট্রমা এখনো পুরো সারেনি। আট বছরে মনে হয় না ত্রিশটা দিনও শান্তিমতো ঘুমিয়েছি। এখন কোনোদিন ৩/৪ ঘন্টা ঘুম হলে মনে হয় অনেক ঘুমিয়ে ফেলেছি। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। মাথার চুল কাঁচা আছে সামান্য। আয়না ঘরে জনৈক শুকছানা বলেছিল, ”এতো স্মার্ট ছেলে কোত্থেকে ধরে নিয়ে এলো।” অনেক কষ্টের মাঝেও হাসি পেয়েছিলো তখন। যদিও সেই স্মার্টনেসের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই আর।
পুরো ক্যারিয়ার প্রায় শেষ। প্রকাশনা, প্রিন্টিং বিজনেস, সম্পাদনা, লেখালেখি খেয়ে দিয়েছে সব৷ শুধু প্রিন্টিং বিজনেসের আট বছরের ক্ষতির হিসাব করলে দুই কোটি টাকা হবে। ”অন্যসময়” নামে একটি সাময়িকী বের করতাম। সেটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজের ও অন্যদের ভালো রাখবার তাগাদায় আলবিদা জানিয়েছি শহুরে জীবনকেও।
।।
বদলে যাবে দিন!
ইচ্ছে ছিলো জামিনে বেরিয়ে প্রথমেই একটা সংবাদ সম্মেলন করবো। কিন্তু ততোদিনে অনেক কিছু বদলে গেছে। কাছের মানুষেরা এমন বিহেব করছে, মনে হচ্ছিল আমি এক দাগী আসামি! ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এড়িয়ে চলছে। যে লেখক ফোরাম বানানো হয়েছিলো লেখকের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য, তারাও কোনো কথা বলেনি। কিন্তু এতো কিছুর পরও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। পরিস্থিতি যা-ই ঘটুক মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়িনি। ওরা তো ভাঙতেই চেয়েছে। ওদের সফল হতে দেবোনা পণ করেছি।
আয়না ঘরের বন্দীদের কথা মনে পড়তো খুব৷ এক বৃদ্ধ মওলানাকে দেখেছি ব্লাডপ্রেসার ও ডায়াবেটিসের রোগী। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিলেও মুক্তি মেলেনি তার। জেলগেট থেকে পুণরায় ঠাঁই হয়েছে আয়নাঘরে।
খুনী রেজিমের পতন জরুরি ছিলো। বিপ্লব বা স্বাধীনতা যাই বলুন, এটি কেবল প্রাথমিক ফলাফল। একজন মুমিন হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, শরিয়ার ছায়াতলে এ ভূমিতে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠাই পারে সব শহিদের, সমস্ত নিপীড়ন ও আত্মদানের দায় মেটাতে। আর শুধু তখনি সমাপ্তি ঘটবে দীর্ঘ ক্লান্তিকর এই সফরের। সেদিনটি আসুক, সহসা আসুক আল্লাহ আযযা ওযালের কাছে এই শুধু প্রার্থনা।
(অনেক কিছু স্কিপ করে গেছি৷ এমনিতে লেখা বড়ো হয়ে গেছে৷ এই যেমন ধরেন- কখনো কখনো মেরে-টেরে মশকরা করে বলবে, ‘কিরে ব্যথা লাগছে?!’ তো আপনি কী বলবেন তখন? গলা ছেড়ে হো হো করে হেসে বলবেন, ‘না স্যার! খু-উ_ব আরাম পাচ্ছি!’
একগ্রুপ মারবে, আরেকগ্রুপ মলম লাগাবে। তৃতীয়গ্রুপটি আপনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে নির্যাতনের লোমহর্ষক হরর টাইপ গল্প বলবে। আবার অন্য কেউ এমন ভান ধরবে যেন সে এসবকিছু একদমই পছন্দ করছে না। পারলে সে আপনাকে বাসায় দিয়ে আসে! আসলে এরা সবাই একি দলের বিভিন্ন রোল প্লে করছে৷ আর এর উদ্দেশ্য আপনার কাছ থেকে তথ্য আদায় বা নিজেদের মর্জিমতো স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারা৷ জেল-জীবনের গল্প আবার ভিন্ন লেভেলের৷ জেল-পরিভাষায় ‘আমদানি’ বা ‘অভ্যর্থনা’ কক্ষ থেকে এই পাঠশালার হাতেখড়ি৷ আল্লাহর তৌফিক হলে এই গল্পও কখনো লিখতে পারি ইনশাআল্লাহ৷ আল্লাহ আযযা ওয়াযাল সবাইকে শকুনির বদনজর থেকে নিরাপদ রাখুন, সুস্থ রাখুন, আমিন৷)
.
#আয়নাঘর