আরমানের বাচ্চারা আপনাকে ক্ষমা করবে না
‘অবশেষে ফিরে পাওয়া’- আট বছর ধরে এক মায়ের রক্তের প্রতিটি কণায় জমা হওয়া হাহাকারের অবসান! তিন শব্দের এই বাক্যটির মধ্যে লুকিয়ে আছে কত যে বুক-ভাঙা দীর্ঘশ্বাস, কত যে আশা-নিরাশার দোলাচল, কত যে জায়নামাজ-ভেজানো চোখের পানি! একজন মায়ের কাছে এই আট বছর সময় যে আসলে কত ‘সময়’, সে বুঝি শুধু মায়েরাই বোঝে। এই আট বছরের অনিশ্চয়তা ঠিক কতটুকু বেদনার ক্ষত তৈরি করে, তা হয়তো শুধু সহধর্মিণীই টের পায়। ছোট ছোট বাচ্চাদের ‘বাবাহীন’- করে রাখার দুই হাজার নয়শ’ বিশ দিনের ক্যালেন্ডার যে কত দীর্ঘ হতে পারে, তা হয়তো আমাদের পক্ষে উপলব্ধি করাই সম্ভব নয়।
মীর আহমাদ বিন কাসেম, যিনি ব্যারিস্টার আরমান নামে পরিচিত, ফিরে এসেছেন। ছেলের ফিরে আসায় মা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন- ‘অবশেষে ফিরে পাওয়া’। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে নিজের বাসা থেকে সাদা পোশাকের কয়েকজন আরমানকে তুলে নিয়ে যায়। তুলে নেয়ার চার সপ্তাহ পর তার বাবা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয় এমন এক রায়ের মাধ্যমে, যা স্বচ্ছ এবং প্রশ্নহীন নয়। আরমান ছিলেন তার বাবার মামলার আইনজীবী। সাদা পোশাকধারীদের তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে আমার বাবার মামলা পরিচালনা করতে হবে। আমার পরিবারের সঙ্গে থাকতে হবে।’ তার আবেদন শোনা হয়নি। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
যথারীতি আইনশৃংখলা বাহিনী তাকে আটকের কথা অস্বীকার করে। তখন থেকেই ব্যারিস্টার আরমান নিখোঁজ। চার সপ্তাহ পর বাবার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার খবরও তার কাছে পৌঁছানো হয়নি। সংবাদ সংস্থা এএফপি’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে আরমান জানান, বাবার মৃত্যুর খবর তিন বছর পরে তিনি জানতে পারেন। আয়না ঘরের এক রক্ষী ভুল করে তাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা জানিয়ে দেয়।
এ রকম শত শত গুম-খুনের অভয়ারণ্য হয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল বিভীষিকাময় এক জনপদ। প্রতিহিংসাপরায়ণ, প্যাথোলজিক্যালি লায়ার, আপাদমস্তক স্বৈরাচারের ডিএনএ দিয়ে নির্মিত এক ব্যক্তির একক শাসনে পরিচালিত হয়েছে এই বাংলাদেশ। ১৬ বছরের প্রতিটি মুহূর্তে সে ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে গেছে গণতন্ত্রহীনতার চর্চায় এবং জনগণকে মানুষ মনে না করার প্রবণতায়। নিজেকে বিকল্পহীন, অপরাজেয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক সত্তায় পরিণত করার প্রয়াস ফুটে উঠতো প্রতিটি কথায়, আচরণে। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উন্মত্ত আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছিল রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার মাধ্যমে। কিন্তু ছাত্র-জনতার জুলাই-জাগরণ পাল্টে দেয় সব হিসাব। অভূতপূর্ব এক গণঅভ্যুত্থানে জন্ম নেয় এক নতুন বাংলাদেশ। ৫ই আগস্ট ঢাকার রাজপথে মানুষের উপস্থিতি, উল্লাস আর উদ্যাপন ছিল এমনই বাঁধভাঙা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসের এর অপরিহার্য উপাদান হয়ে টিকে থাকবে যুগসন্ধিক্ষণের দলিল হিসেবে। ক’দিন আগেও ‘শেখ হাসিনা পালায় না’- বলে যে হুঙ্কার দিয়েছিলেন, ছাত্র-জনতার গণভবনমুখী স্র্রোতের শব্দে বিহ্বল হয়ে ৪৫ মিনিটের মধ্যেই বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন অহঙ্কারের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠা শেখ হাসিনা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বাংলাদেশের মানুষ। আক্ষরিক অর্থেই নতুন এক মুক্তির অনুরণনে হৃদয় জুড়িয়ে যায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের।
এমন প্লাবিত মুক্তির মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। শেখ হাসিনার নিকৃষ্ট সৃষ্টি ‘আয়না ঘরের’- অন্ধকার আয়নাও মুক্তির রঙিন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গুমের শিকার মানুষগুলোর কেউ কেউ আয়না ঘর থেকে মুক্তি পেতে শুরু করে। হঠাৎই খবর পাওয়া যায় আট বছর পর ব্যারিস্টার আরমান ফিরে আসেন। ফিরে আসেন সালমান আল আযমীসহ আরও কেউ কেউ। ৩২ বছরের আরমান আট বছরের অনিশ্চয়তা দূর করে ৪০ বছর বয়সে মায়ের বুকে ফিরে আসেন। বাচ্চাগুলো তাদের ‘ভুলে’- যাওয়া বাবাকে ফিরে পায়।
কেমন ছিল আট বছরের আয়না ঘরের জীবন?
ব্যারিস্টার আরমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছে এএফপি। আরমান জানান, ‘আট বছরের মধ্যে সেদিন (মুক্তির দিন) আমি প্রথমবারের মতো মুক্ত বাতাস পাই। আমি ভেবেছিলাম তারা আমাকে মেরে ফেলবে।’ আরমানকে রাখা হয়েছিল জানালাবিহীন একটি ঘরে। এই কারাগারে যারা থাকেন, সেখানে তারা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পান না। এনটিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আরমান বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছিল, আমি জীবন্ত অবস্থায় কবরে আছি। আমি চিন্তা করতে পারিনি যে, আমি কোনোদিন দিনের আলো দেখবো।’ একজন বাবার কাছে পুরো পৃথিবী একদিকে, সন্তান একদিকে। আরমান বলেন, ‘সবচেয়ে কষ্ট লাগছিল সন্তানদের জন্য। আমি যদি জানতাম, আমার সঙ্গে এই আচরণ করা হবে, ওদেরকে একটু আদর করে আসতাম।’ ভাঙা গলায় কাঁদতে কাঁদতে আরমান জানান, আমি বাচ্চাদের সঙ্গে আর দেখা হওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাচ্চারা আশা ছাড়েনি। তারা জানতো, আমি ফিরবো।
কেমন ছিল প্রতিদিনের ২৪ ঘণ্টা?
এই প্রশ্নটির উত্তর আমাদের পক্ষে উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব। যে রকম অসম্ভব মৃত্যুর আগে কবরের জীবন সম্পর্কে আগাম উপলব্ধি। সময়বোধ হারিয়ে যাওয়া এক জীবন! ব্যারিস্টার আরমান কাঁদতে কাঁদতে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, সময় বুঝতে পারতাম না। ফজরের আজান শুনে (যেহেতু ফজরের আজানে একটি বাড়তি বাক্য যুক্ত থাকে) বুঝতাম এখন সকাল। যদিও আজানের শব্দও তাকে শুনতে দেয়া হয়নি বড় ভলিউমে মিউজিক বাজিয়ে। আরমান জানান, ২৪ ঘণ্টা হ্যান্ডকাফ পরা থাকতো। দিনের বেলা হাতের সামনের দিকে। রাতে পেছনে। প্রায়ই শোনা যেত অন্য বন্দিদের কান্নার শব্দ। বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে তারা কাঁদতো।
প্রিয় পাঠক, আয়না ঘর নামের এই ‘কবরে’- শুধু আরমান নন; শুধু সালমান আল আযমী নন; ছিলেন গাজীপুরের মালয়েশিয়া প্রবাসী সেলিম, পাবর্ত্য চট্টগ্রামের মাইকেল চাকমাসহ আরও অনেকে। মুক্তির পর সেলিম, মাইকেলদের সাক্ষাৎকার গণমাধ্যমগুলো প্রচার করছে। ইউটিউবে দেখা যায়। দেখুন। দেখুন এই মানুষগুলোর কোনো অপরাধ ছিল কিনা। স্বজন হারানোর বেদনা বোঝার একক ঠিকাদারি নিয়ে মিথ্যা আবেগে মানুষকে বিভ্রান্ত করার পৈশাচিক উন্মাদনায় আক্রান্ত শেখ হাসিনা কীভাবে এ রকম একটি নারকীয় বন্দিশালা টিকিয়ে রেখেছিলেন! কী অপরাধ ছিল আরমানের ছোট্ট বাচ্চা দু’টির? দিনের পর দিন, বছরের পর পর তাদেরকে বাবাবঞ্চিত করার নির্মম জুলুমের কী জবাব আছে? কেমন কেটেছে আরমানের মায়ের ১৬টি ঈদ? কোনো স্কেল দিয়ে মাপা যাবে আরমানের স্ত্রীর প্রতিটি মুহূর্তের কষ্টগুলো? কে ফিরিয়ে দিবে এক প্রতিশ্রুতিশীল খ্যাতিমান আইনজীবীর আটটি বছর? আলোহীন, মনুষ্য-যোগাযোগহীন এক অস্বাভাবিক-অনিশ্চিত জীবন আরমানের মধ্যে যে ট্রমার সৃষ্টি করেছে, কে নেবে এর দায়?
শেখ হাসিনা, পৃথিবীর আদালতে আপনার বিচার হবে কিনা জানি না। যাবতীয় আদালতে আপনি হয়তো মুক্তিও পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আরমানের ছোট্ট মেয়ে দু’টি আপনাকে ক্ষমা করবে না। ‘মায়ের ডাক’- ব্যানারে গুম হওয়া বাবাদের ছবি বুকে নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা বাচ্চাগুলো আপনাকে ক্ষমা করবে না। মায়েদের, বোনদের, সহধর্মিণীর চোখের পানি আপনার জন্য যে মহাসমুদ্র তৈরি করেছে, সেখান থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। আপনার নিষ্ঠুরতা সম্ভবত আমাদের ভাবনার চেয়েও তীব্র, গভীর।
-রফিকুজ্জামান রুমান