আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া পুনর্বাসন কর্মসূচি ব্যর্থ

জুমবাংলা ডেস্ক : ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল ও ভিক্ষুক পুনর্বাসনে ২০১০ সালে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ কর্মসূচি হাতে নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে এই কর্মসূচি যে ব্যর্থ হয়েছে, শহরের চারদিকে তাকালে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ মেলে। শুধু রাজধানী নয়, দেশের সব শহরের একই চিত্র। সবখানে ভিক্ষুকের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য। কালের কণ্ঠ’র করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি ব্যর্থফুটপাত, রাস্তা, ট্রাফিক সিগন্যাল, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল, মার্কেট, স্কুল-কলেজের সামনে, মসজিদের প্রবেশপথে, মাজার, বাসাবাড়ি—সর্বত্র ভিক্ষুকের প্রসারিত হাত। এই পরিস্থিতির মধ্যে দেশে যে ভিক্ষুক পুনর্বাসনে একটি কর্মসূচি চলমান রয়েছে, তা অনুমান করা কষ্টকর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত পরিকল্পিত পরিকল্পনার অভাবেই এই কর্মসূচি ব্যর্থ।
মিরপুরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার জুমার নামাজের সময় রাজধানীর প্রতিটি মসজিদের সামনে ভিক্ষুকের সারি দেখে সহজে অনুমান করা যায়, রাজধানীতে কয়েক লাখ ভিক্ষুক রয়েছে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সরকারের ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হতো তাহলে ভিক্ষুকের সংখ্যা এভাবে বাড়ত না।
রাজধানীর বিমানবন্দরে প্রবেশপথের পূর্ব পাশের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশের এলাকা, র্যাডিসন হোটেলসংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলি রোড, সোনারগাঁও হোটেল, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলসংলগ্ন এলাকা, রবীন্দ্রসরোবর এবং কূটনৈতিক জোনগুলো ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এসব এলাকায়ও হরহামেশা ভিক্ষুক দেখা যাচ্ছে।
আমিরুল ইসলাম নামের ধানমণ্ডির এক বাসিন্দা বলেন, ‘ভিক্ষুকরা বাসে উঠে, প্রাইভেট কার, সিএনজির সামনে দাঁড়িয়ে গ্লাসে ধাক্কা দিয়ে ভিক্ষা চায়। দুই টাকা, পাঁচ টাকা দিতে চাইলে নিতে চায় না। মনে হচ্ছে এরা সবাই ধনী ভিক্ষুক!’
তবে সমাজসেবা অধিদপ্তর জানায়, ভিক্ষুক পুনর্বাসনে মোবাইল কোর্ট কাজ করছে। পুনর্বাসনকেন্দ্রে নিয়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে উপার্জনের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। এর পরও প্রশিক্ষণ শেষ হলে অনেকে আবার পুরনো পেশায় ফিরে যায়।
ফলে শহরগুলো ভিক্ষুকমুক্ত করা যাচ্ছে না। কিভাবে শহরগুলো ভিক্ষুকমুক্ত করা যায় সে বিষয়ে কার্যকর কোনো পরিকল্পনাও নেই।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভিক্ষুক, চা শ্রমিক ও হিজড়া) মো. শাহজাহান বলেন, ‘ভিক্ষুকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের পুনর্বাসনে প্রতিবছর কর্মসূচিতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। বরাদ্দ কম থাকায় চাহিদা অনুযায়ী ভিক্ষুক পুনর্বাসন করা যাচ্ছে না। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন করতে বাজেটে বরাদ্দ আরো বাড়ানো দরকার।’
তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আটক ভিক্ষুকদের রাখার জন্য পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্রের ফাঁকা জায়গায় অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৬টি টিনশেড ডরমিটরি ভবন নির্মাণকাজ চলমান।’
নামকাওয়াস্তে অর্থ বরাদ্দ
২০১০ সালের পর গত ১৩ বছরে ভিক্ষুক পুনর্বাসন বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭৫ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এই সময় মাত্র ১৫ হাজার ভিক্ষুক পুনর্বাসন করা গেছে। তবে তাদেরও বড় একটি অংশ আবারও ভিক্ষা পেশায় ফিরে গেছে। ফলে সরকারের এই কর্মসূচি সফল হচ্ছে না।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ কর্মসূচি শুরু হলেও ওই অর্থবছরে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ২০১০-১১ অর্থবছরে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় তিন কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জরিপ পরিচালনা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় হয় ১৮ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ছয় কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও খরচ হয় ৪৮ লাখ টাকা।
এই বছরে মাত্র ময়মনসিংহে ৩৭ জন ও জামালপুরে ২৯ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয় ১০ কোটি টাকা। এ বছর কোনো ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়নি। আবার ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোনো অর্থ ছাড় করা হয়নি।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও খরচ হয় সাত লাখ টাকা। এই টাকা রাজধানীর ফুটপাতে বসবাসকারী শীতার্ত ব্যক্তিদের সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া ও আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় করা হয়। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই দুই অর্থবছরে পুনর্বাসন করা হয় ৬৬১ জন ভিক্ষুককে।
২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে দুই অর্থবছরে তিন কোটি করে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই দুই অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৪২০ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই অর্থবছরে দুই হাজার ৮৫০ জন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া ২৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ৩৭টি জেলায় তিন হাজার ভিক্ষুককে পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানে খরচ করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই সময় তিন হাজার ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে এই টাকা এখনো ছাড় করা হয়নি বলে জানিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
দেশে ভিক্ষুক কত
দেশে কতসংখ্যক ভিক্ষুক রয়েছে এখনো তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী দেশে আড়াই লাখ ভিক্ষুক রয়েছে। তবে এটিও ধারণানির্ভর। এরপর আর কোনো জরিপ করা হয়নি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন উপপরিচালক জানান, সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা নির্ধারণে একটি জরিপ পরিচালনা করেছিলেন।
তিনি জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, দেশে সাত লাখ ভিক্ষুক রয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদ জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে মসজিদের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। নজরুল আমিন নামের আজিমপুরের এক বাসিন্দা জানান, যদি প্রতিটি মসজিদের সামনে ২০ জন করে ভিক্ষুক উপস্থিত হয়, তাহলে দাঁড়ায় এক লাখ ২০ হাজার ভিক্ষুক। তাহলে সারা দেশের চিত্র কী তা সহজে অনুমেয়।
ভিক্ষুক পুনর্বাসন নিয়েও রয়েছে রাজনীতি
রাজধানীতে নিয়মিত ভিক্ষুক দেখা গেলেও তৎকালীন আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীরা তা মানতে নারাজ ছিলেন। ২০১৫ সালে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই বলে এবারের বাজেটে ভিক্ষুক পুনর্বাসনে কোনো বরাদ্দ রাখতে হয়নি।’
২০২১ সালে সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, ‘দেশে ভিক্ষুক নেই বলে মানুষকে ডেকে ডেকে চাল দিতে হয়।’ ২০২২ সালে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, ‘দেশের কোথাও আর ভিক্ষুক দেখা যায় না।’ আর ২০২৩ সালে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেছিলেন, ‘দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই।’
যা করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর
রাজধানীর মিরপুর, নারায়ণগঞ্জের বেতিলা, গাজীপুরের কাশিমপুর ও পুবাইল জমিদারবাড়ি, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধলা এবং মানিকগঞ্জের পুরনো জমিদারবাড়িতে সরকারি ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন করা হয়। সরকারিভাবে এক হাজার ৭০০ জন ভবঘুরেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রাখার সুযোগ রয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন, পুরনো জমিদারবাড়িগুলো সংস্কারের অভাবে ধারণক্ষমতা কমে গেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৪১টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে দুই হাজার ৯০০ জন ভিক্ষুককে আটক করা হয়। তাদের রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় ৭৫০ জনকে (ভিক্ষাবৃত্তি না করার শর্তে) মুক্তি দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহে আশ্রয়কেন্দ্রে ভিক্ষুকদের জন্য ছয়টি শেড নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি শেডে ৫০ জন করে ভিক্ষুক রাখা যায়। সে হিসাবে ৩০০ জন রাখার সুযোগ আছে। তবে বর্তমানে সব মিলিয়ে ৫০ জন ভিক্ষুক আছে। ময়মনসিংহ সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাজু আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব ভিক্ষুকের প্রশিক্ষণের জন্য আপাতত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের কাছে ভিক্ষুক পাঠানো হলে আমরা এখানে আশ্রয় দিয়ে থাকি।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা সাত লাখ। এর মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার পুনর্বাসন করা হয়েছে। তার মধ্যেও অনেকে আবার ভিক্ষা পেশায় ফিরে গেছে।
সমাজকর্মী শহীদুল ইসলামের মতে, রাজধানীতে ভিক্ষুক নিয়ে সিন্ডিকেট আছে। মাসিক বা রোজ চুক্তিতে এসব সিন্ডিকেট ভিক্ষুক সংগ্রহ করে। ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে সরকারের কৌশলী পরিকল্পনা জরুরি।
মাতৃভূমিতে ফেরার নতুন আশায় বুক বাঁধছেন রোহিঙ্গারা
সোর্স: জুম বাংলা